ফোন- ভাই দোয়া করো নিউ ইয়র্ক থেকে চিচু আপার। পবিত্র কোরআন পড়ে আমাদের জন্য দোয়া করো। বেঁচে আছি এক মৃত্যুউপত্যকায়। চারদিকে মৃত্যুর হাতছানি। দম টানার বাতাসটাও বিষিয়ে গেছে। ভয় হয়, এই বুঝি করোনা ধরে ফেলে। ভৌতিক সিনেমায়ও এমন দৃশ্য হয় না। কথাগুলো বলছিলেন আর বার বার থেমে যাচ্ছিলেন।
তার গলা ভারি হয়ে আসছিল। তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিলেন এ জন্য যে,
আল্লাহ না করুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঘরের ভিতর মরে পড়ে থাকলে বা অগত্যা
হাসপাতাল পর্যন্ত গন্তব্য হলে এবং সেখানে যদি মারা যান, তাহলে মৃতদেহটি
ছোঁয়ার কেউ থাকবে না। পরিস্থিতি এমনই কেউ করোনায় মৃতদেহ স্পর্শ করছে না। এ
ভাইরাসে কেউ মারা গেছেন শুনলেই ভয়ে ছিটকে দূরে চলে যান।
চিচু আপা আমার
আপন বোন নন। কিন্তু আপনের চেয়েও আপন হয়ে উঠেছেন। আল্লাহর দুনিয়ায় কেন যে
মানুষ এতটা মায়াময় হয়, এতটা মানবী হয় ভাবতে ভাবতে চোখে অশ্রু জমে। কেমন করে
চিচু আপা আমার বোন হয়ে উঠলেন সে কথা না হয় অন্য কখনো শেয়ার করা যাবে।
চিচু
আপা ফরিদপুরের মেয়ে। আসল নাম আসমা বেগম। আমার কলেজ, সরকারি রাজেন্দ্র
কলেজের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ফেসবুকে ভার্চুয়াল একটি গ্রুপের মাধ্যমে তার সঙ্গে
আমার পরিচয়। আমার অতীত শুনে তার ভিতরকার মাতৃহৃদয় কেঁদে ওঠে। সংক্ষেপে
বলি- তিনি আমার বোন হয়ে ওঠেন। তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করেন। অনেকদিন আপার খবর নিই না। এই
নিদানের সময়ও না। কাজের ব্যস্ততায় হয়ে ওঠে না। আজ সকালে সব কিছু বাদ দিয়ে
আপাকে ম্যাসেঞ্জারে ফোন দিলাম। ওপাড়ের যে বর্ণনা দিলেন তিনি, তাতে গায়ের
লোম শিহরিত হলো। ভয়ে চুপসে গেলাম।
আপা বললেন- ঘরের বাইরে যাওয়ার কোনো
উপায় নেই। বাইরে পা ফেললেই ৫০০ ডলার জরিমানা। যার যার ঘরে বন্দি। আমার ও
তোমার দুলাভাইয়ের ঠান্ডা, কাশি। ভয় হচ্ছে। ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন তা
অর্ডার করা হয়েছে। কিন্তু আসতে তিন দিন সময় লাগবে। স্টক শেষ। মানুষ শুধু
আহাজারি করছে। কাউকে কেউ শান্তনা দেয়ার নেই। কোথাও একটা দোকান খোলা নেই।
চারদিকে শুধু মৃত্যু বিভীষিকা। পাশেই একটি পরিবার থাকে। স্বামী স্ত্রী
চাকরি করেন। দুটি বাচ্চা তাদের। স্ত্রী চাকরি করেন একটি হাসপাতালে। শুনেছি
তিনি করোনায় সংক্রমিত। আজ দু’তিন দিন তাকে দেখছি না। তার অবস্থা কি জানি
না। তার স্বামী যখন ঘর থেকে বের হলেন তার মুখ মলিন। বাচ্চা দুটির কি অবস্থা
কিছুই জানি না। চারদিকে অর্থনীতি শেষ। সবার হাতের জমানো অর্থ শেষ। এই
জরুরি মুহূর্তের পর কি হবে আল্লাহই ভাল জানেন। চারদিকে এক হাহাকার দেখতে
পাচ্ছি। তোমাদের পত্রিকার সাংবাদিক এ হাই স্বপন মারা গেছেন এই নিউ ইয়র্কে।
তাকে ভালভাবে চিনতেন তোমার দুলাভাই। খুব কষ্ট লাগছে তার জন্য। তিনি সুস্থ
থাকার জন্য, ভাল থাকার জন্য উন্নত যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু
সেখানেই তাকে প্রাণ হারাতে হলো এমন এক ভাইরাস সংক্রমণে, যার সামনে দাঁড়ানোর
সাহস এখন পর্যন্ত দুনিয়ার কারো হয় নি।
আপা কথা বলছেন আর কাঁদছেন।
বিভিন্ন রাজ্যে থাকেন তার ভাই-বোনেরা। তারা সবাই ফোন করছেন আর হাউমাউ করে
কাঁদছেন। কারো সাথে কারো মুখ দেখাদেখি নেই। কে বাঁচবেন, কে মরবেন কোন
নিশ্চয়তা নেই। অন্য ভাইবোন ফোন করে কাঁদেন। সে কান্না শুধু বাতাসে মিলিয়ে
যায়। দেখার কেউ নেই। ঘর থেকে বাইরে পা রাখা নিষেধ। নিউ ইয়র্ক শহরের বিভিন্ন
হাসপাতালের মর্গ বোঝাই লাশ। এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই তাতে। ট্রাকে গাদি
মারা হচ্ছে। মানুষ বেঁচে আছে- কিন্তু মরে বেঁচে থাকা বলে একে।
আপার
সবচেয়ে ছোট বোনটি চাকরি করেন একটি ব্যাংকে। কিন্তু সেখানে ছুটি নেই। তাই
বাধ্য হয়ে অফিসে যেতে হচ্ছে তাকে। ভোর সাড়ে চারটায় গাড়ি হাঁকিয়ে ছোটেন
তিনি। ব্যাংকে পৌঁছে মুখে মাস্ক পরা নিষেধ। কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনে
করছে, তিনি মাস্ক পরলে অন্যরা তাকে ভয় পাবেন। মনে করবেন তিনি করোনা
আক্রান্ত। ফলে নিত্যঝুঁকি নিয়ে তাকে অফিস করতে হচ্ছে। চিচু আপা কাঁদেন আর
বলেন- আমাদের বড় আদরের বোন। ও আমার কাছে থাকে না। ও অফিসে যায় শুনি, আর এক
আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে। অন্য রাজ্যে বসবাস করেন এক ভাই। তিনি ফোন করে
কাঁদেন। আরেক বোন ফোন করে কাঁদেন। কি করবো মাথা ঠিক থাকে না। অহর্নিশ তাই
এক আল্লাহকে ডাকছি। নামাজ আদায় করে পবিত্র কোরআন নিয়ে বসে থাকি। আল্লাহ যদি
করুণা করেন।
কোনো দোকানপাট খোলা নেই। চারদিকে বিরানভূমি। যেন এ শহরের
সব মানুষ বিগত হয়েছেন। পড়ে আছে এক বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত নগরী। এর মাঝেই
প্রাণস্পন্দন নিয়ে বেঁচে আছি। জানি না কতক্ষণ, কতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে
রাখবেন। বলতে বলতে কণ্ঠ আরো ভারি হয়ে আসে চিচু আপার- আল্লাহর কাছে এই কামনা
করি। হে আল্লাহ পৃথিবীতে যখন এসেছি, জানি নিশ্চিত একদিন চলে যেতে হবে। তাই
বলে এমন মৃত্যু দিও না, যে মৃত্যুতে কেউ আমার মৃতদেহ স্পর্শ করবে না।
আত্মীয়-স্বজনরা দূর থেকে অশ্রু বিসর্জন দেবে না। আল্লাহ তুমি মৃত্যু দিও
ঈমানের সঙ্গে।
আপার কথা শুনতে শুনতে অশ্রুসিক্ত হয় চোখ। কখন গ- বেয়ে
গড়িয়ে পড়ে অশ্রু বুঝতেও পারি না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। করোনা
ভাইরাস নামের এই অভিশাপ থেকে পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানুষদের মুক্ত রাখুন।