লন্ডনের ব্যস্ত সলিসিটর বয়সে তরুণ। আব্দুল হামিদ টিপু। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে আছে সব সময়। ঘাতক কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, সে যুদ্ধে টিপুও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
ইংল্যান্ডে বিশেষ করে লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির ভেতরে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য কয়েকদিন পর পর ফেইসবুক লাইভ প্রোগ্রাম করছেন টিপু। স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি করার সাথে সাথে করোনার প্রভাবে বৃটিশ জনগণের আর্থসামাজিক জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তা মোকাবিলা করার জন্য বৃটিশ সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা বিষয়ে মানুষের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য টিপুর লাইভ অনুষ্ঠান সাহায্য করছে। তার লাইভ অনুষ্ঠানে ডাক্তার, একাউন্টেন্ট, সলিসিটর এবং ব্যারিস্টাররা এসেছেন এবং আসছেন।
তেমনি একটি লাইভ অনুষ্ঠান ছিল শনিবার রাতে। অন্যদের ভেতর আমিও ছিলাম। ব্যারিস্টার লুৎফুর রহমান এবং ব্যারিস্টার আব্দুস শহীদও গেস্ট লিস্টে ছিলেন।
কথা বলছিলাম করোনার বিরুদ্ধে গ্রেট বৃটেন এখন কোথায় অবস্থান করছে তা নিয়ে। শনিবারের হিসেব অনুসারে মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় ৬ ভাগ। ভয়াবহ সংবাদ। সবার জন্যই ভয়ংকর অস্বস্তির ব্যাপার। শুক্রবার পুরো যুক্তরাজ্য জুড়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ৭৫৯। কিন্তু সেই সংখ্যা এক লাফে ১০১৯ এ পৌঁছে যায় শনিবারে। ২৪ ঘন্টায় ২৬০ টি মৃত্যু। সব পত্রিকা এবং নিউজ চ্যানেলের হেডিং হয়ে আছে এই সংবাদ।
যুক্তরাজ্যে এই মুহূর্তে প্রতিদিন ৬০০০ করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ বা মাঝামাঝির দিকে সেই সংখ্যা দৈনিক ১০,০০০ এ উন্নীত হবার কথা। এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন শুধু তাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। শনিবারের হিসেব অনুসারে এ পর্যন্ত মোট ১,২০,৭৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর উপর করোনাভাইরাস সন্দেহে টেস্ট করা হয়েছে। তার ভেতরে ১৭০৮৯ জন বা শতকরা ১৪.১৪ জন রোগী করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছেন। তার মানে হচ্ছে জ্বর বা কাশি নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের ভেতর শতকরা ৮৫ জন কভিড ১৯ পজিটিভ নন।
লাইভ অনুষ্ঠানের শেষের দিকে হঠাৎ করে নিক্সন চৌধুরীর ফোন এলো। বৃটেনের ওল্ডহামের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ব্লু টিফিন রেস্টুরেন্টের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছেন তিনি। তাঁর মুখেই শোনা যাক পুরো ঘটনাটি-
‘মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশের যখন ছিলেন তখন নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। এক সময় তিনি আবাহনীতে ফুটবল খেলেছেন। লন্ডনে চলে আসার পরও ফুটবল থেকে তিনি ফিরে আসেননি। সপ্তাহে কম করে হলেও ৩ দিন তার ফুটবল খেলতেই হবে। শারীরিকভাবে খুবই সুস্থ মাহবুবুর রহমানের বয়স মাত্র ৩৭ বছর। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন। এখনো বাবা হননি। স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনের এক বাসায় থাকেন এবং একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন।
বৃটিশ সরকার গত সপ্তাহে রেস্টুরেন্ট গুলো বন্ধ রাখার জন্য আহ্বান জানায়। তবে এখানে একটি ফাঁক থেকে যায়। ফাঁকটি হচ্ছে বাসায় খাবার ডেলিভারি দেয়া যাবে। কিন্তু রেস্টুরেন্টে কাস্টমার আসতে পারবেনা। এ ধরনের খাবার দোকানগুলোকে টেকওয়ে বলা হয়। কিন্তু কিছু কিছু রেস্টুরেন্ট এই সুযোগে শুধু ফুড ডেলিভারি দেয়ার জন্য খোলা থেকে যায়। মাহবুবুর রহমান ছিলেন এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারী। তার ছুটি হবার কথা থাকলেও ছুটি হয়নি এবং তাইই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
শরীরে একটু জ্বর জ্বর আসলে তা নিয়েই তিনি রেস্টুরেন্টে কাজে চলে যান। দুদিন কাজ করার পর বেশি খারাপ লাগতে শুরু করে। বাসায় চলে আসেন। গায়ের জ্বর তখন ৩৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। কাশি শুরু হয়েছে। মাহবুবুর রহমান ভয় পেয়ে যান, তিনি কি করোনাতে আক্রান্ত হলেন? বৃটিশ গাইডলাইন অনুসারে প্রথম সপ্তাহে তার ১১১ নাম্বারে ফোন করার কথা নয়। তারপরও ভয় পেয়ে তিনি ফোন করেন। তাকে বলা হয় হোম আইসোলেশনে থাকার জন্য। জ্বর শুরু হবার প্রথম দিন থেকে ৭ দিন পর্যন্ত বাসায় থাকার জন্য বলা হয়। বলা হয় সাত দিনের ভেতর যদি জ্বর এবং কাশি না যায় তাহলে ১১১ নাম্বারে আবার ফোন করার জন্য। এই সাত দিনের ভেতরে শ্বাসকষ্ট হলে বা শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হলে ১১১ বা ৯৯৯ ইমারজেন্সি নাম্বারে ফোন করার জন্য বলা হয়। মাহবুবুর রহমানের স্ত্রীকে বলা ১৪ দিন বাসায় আইসোলেশনে থাকার জন্য।
কপাল ভালো কয়েকদিনের ভেতরে মাহবুবুর রহমানের জ্বর কমতে থাকে। তবে কিছু খুসখুস কাশি থেকে যায়। জ্বরের অষ্টমদিনে ১১১ নাম্বারে ফোন করে মাহবুবুর রহমান ডাক্তারের সাথে কথা বলেন। যেহেতু তিনি সাত দিনের ভেতর পুরো সুস্থ হননি, তাই তাকে এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা হয়। একই দিনে মাহবুবুর রহমান অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করেন। পরবর্তী তিন দিনে তার শরীরের প্রভূত উন্নতি হয়। জ্বর এবং কাশি সম্পূর্ণ চলে যায়। মাহবুবুর রহমান প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর কয়েকটি দিন পরই তিনি কাজে ফিরে যেতে পারবেন। বলাবাহুল্য, তার করোনা টেস্ট করা হয়নি। হাসপাতালে রোগী ভর্তি না হলে এখানে করোনা টেস্ট করা হয় না।কিন্তু করোনা রোগের সর্তকতা অবলম্বনের জন্য তাকে বলা হয়েছিল। তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছিলেন।
শুক্রবার। জ্বর আসার ১২ তম দিন। প্রায় সুস্থ বোধ করছেন। আর দুদিন গেলেই তিনি কাজে ফিরতে পারবেন। নিক্সন চৌধুরীর সাথে ফোনে আলাপ হয়। আত্মীয় এবং বন্ধু। মাহবুবুর রহমান তাকে জানান যে তিনি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। স্ত্রীর মুখে হাসি। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা খুশি যে মাহবুবুর রহমানের বিপদ প্রায় কেটে গেছে।
শুক্রবার রাত দুটো। মাহবুবুর রহমান নামাজ পড়ছিলেন। স্ত্রী পাশের রুমে শুয়ে আছেন। জায়নামাজে বসে থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ করে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আগে কখনোই শ্বাসকষ্ট হয়নি। শ্বাসকষ্ট নিয়েই স্ত্রীকে ডাকেন। স্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। ফোন করেন ৯৯৯ ইমারজেন্সি নাম্বারে। কয়েক মিনিটের ভেতরে এম্বুলেন্স চলে আসে। তবে এম্বুলেন্স পৌঁছার আগেই মাহবুবুর রহমান চিরদিনের জন্য চোখ বন্ধ করেন। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ৩৭ বছর বয়সী বাংলাদেশী এই তরুণ। সন্দেহজনক করোনা রোগী হিসেবে গণ্য করায় মাহবুবুর রহমানের মৃতদেহ বিশেষ প্রটেকশনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
আজ রোববার হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। মাহবুবুর রহমানের করোনা টেস্টের রেজাল্ট এসেছে। তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। স্ত্রীকে হোম আইসোলেশন রাখা হয়েছে। মাহবুবুর রহমান যে রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন সে রেস্টুরেন্টের (টেকওয়ে) সব স্টাফকে হোম আইসোলেসনে পাঠানো হয়েছে। রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এবং কমিউনিটি শোকে স্তব্ধ।”
নিক্সন চৌধুরীর গলা ভারী হয়ে আসে। তিনি আর কথা বলতে পারেন না। একজন পরিচিত বন্ধু এবং আত্মীয় এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবে তা তার কল্পনার অতীত ছিল। কভিড ১৯ সবকিছু তছনছ করে দিলো।
জ্বর আসার সাতদিনের ভেতরে মাহবুবুর রহমান প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। বাকি চার দিন উনার গায়ে জ্বর কিংবা তেমন কাশি ছিল না। করোনাভাইরাস নিয়ে ওনার যে ভয় ছিল তা কেটে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। স্ত্রীর মুখে হাসি ফিরে আসে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনরা আনন্দিত হন। মাহবুবুর রহমানের বিপদের প্রথম সাতদিন ভালোয় ভালোয় অতিক্রান্ত হয়েছে। ৮ম দিনে এন্টিবায়োটিক দেবার পর খুব ভালোভাবে তিনি রেসপন্স করছিলেন। অবশিষ্ট কিছু লক্ষণ এবং উপসর্গ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। তাই স্বপ্ন দেখছিলেন আর দুদিন পরই কাজে যোগ দেবেন।
জ্বরের ১২ দিনের মাথায় উনি যখন প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন ধরেই নিয়েছিলেন করোনার ভয় এখন আর নেই। সবচেয়ে ক্রিটিকাল প্রথম সাত দিন উনি কাটিয়ে দিয়েছেন কোন জটিলতা ছাড়াই। করোনা ভয়ের গল্পটা এখানেই সমাপ্তি হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জ্বরের ১৩ দিন, সে গল্পটি শেষ হয়নি। শেষ গল্পের পরেও আরেকটি গল্প তার জন্য অপেক্ষা করছিল। মাহবুবুর রহমানের করোনা যুদ্ধের গল্পটি হয়ে গেল শেষ গল্পের পরের গল্প।
ফুটনোট
১. প্রাইভেসি রক্ষার স্বার্থে রোগীর আসল নাম উল্লেখ করা হয়নি।
২. উপরের ঘটনাটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত।
৩. বৃটিশ গাইডলাইন অনুসারে কারো গায়ে ৩৭.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকলে তাকে সরাসরি পুরো পরিবারসহ হোম আইসোলেশনে চলে যেতে হবে।
৪. এক সপ্তাহ পর জ্বর এবং কাশি সুস্থ না হলে ডাক্তার বা নার্সের সাথে কথা বলার জন্য ১১১ নাম্বারে ফোন করা যেতে পারে।সম্ভাবনা আছে যে তাকে এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা হবে।
৫. রোগের যে কোন পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করলে রোগীকে বিশেষায়িত করোনা হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।
৬. জ্বর শুরু হবার সাত দিনের দিকে যদি জ্বর এবং কাশি চলে যায় তাহলে মোটামুটি ধরে নেয়া যায় যে রোগী সুস্থতার পথে আছে। মাহবুবুর রহমানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমী ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জ্বর আসার প্রথম ১৪ দিনের ভেতর যে কোন সময় ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
লেখক বৃটেনে কর্মরত বাংলাদেশী সাইকিয়াট্রিস্ট