আসন সংখ্যা ৫৫টি সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে। পুরো ট্রেনে যাত্রীদের জন্য আসন রয়েছে ৮৯৯টি। এই ট্রেনের একেকটি টিকেট যেন সোনার হরিণ। অন্যান্য সময় নানা চেষ্টা করেও যেখানে একটি টিকেট পাওয়া দুষ্কর সেখানে গতকাল এই ট্রেনের বহু টিকেটই অবিক্রিত থেকে গেছে। ৫৫ জনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে দেখা মিলেছে মাত্র ৯ যাত্রীর। একই অবস্থা আকাশ পথেও। এয়ার এরাবিয়া, ইউএস বাংলা, রিজেন্ট এয়ার এবং বাংলাদেশ বিমানের বহু ফ্লাইটই বাতিল হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বহু রুট। যেসব রুটে বিমান চলাচল করছে সেখানেও কমে গেছে যাত্রী। এছাড়া সড়ক পথে প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যে সংখ্যা যাত্রী যাতায়াত করেন এখন তা এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
করোনাভাইরাস আতংকে এভাবে সব পথেই যাত্রী সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। এতে শুধু বিমান, রেল কিংবা সড়ক পরিবহন খাতে লোকসান নয়; তাতে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে দেখা দেয়া ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় দেড়শ’টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ। অসুস্থ হয়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। চীন থেকে শুরু হওয়া এই ভাইরাসটি পৃথিবীর নানা হিসাব নিকাশ পাল্টে দিতে শুরু করেছে। পাল্টে দিচ্ছে অর্থনীতির গতি প্রকৃতিও। পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে পর্যটনসহ নানা খাত উলোট-পালট করে দিচ্ছে। হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতির মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও সিভিল এভিয়েশনসহ নানা ব্যবসা বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস সম্প্রতি বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। প্রথম দফায় তিনজন এবং দ্বিতীয় দফায় আরো দুইজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বাকিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও আতংকের কমতি নেই। উদ্বেগ-উৎকন্ঠা প্রতিদিন বাড়ছে। ব্যাপক অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মাঝে ইতোমধ্যে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন গণজমায়েতের পথ থেকে সরে এসেছে। স্কুল কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা চালু রাখা না রাখার বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে।
ভয়াবহ এই অবস্থায় মানুষের চলাচল বহুলাংশে কমে গেছে। জরুরি কোনো কাজ ছাড়া মানুষজন তেমন দূরে কোথাও যাচ্ছেন না। বাংলাদেশ রেলওয়ের সবগুলো ট্রেনেই যাত্রী কমেছে। গতকাল সূবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে সর্বমোট ৮৯৯টি সিটের বিপরীতে অন্তত দুইশ’ সিট খালি গেছে। রেলওয়ে স্টেশনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা যাত্রী সংখ্যা কমার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, প্রতিটি ট্রেনেই যাত্রী কমেছে। প্রত্যেক রুটেই আগের তুলনায় যাত্রী চলাচল কম। রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার মাহবুবুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমেছে ঠিক। তবে তা খুব বেশি নয়। রেলওয়ের প্রাত্যহিক রাজস্ব আয় কিছুটা কম হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাত্রী সংখ্যা আরো কমে যাবে বলে মনে হচ্ছে। অপর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সবগুলো ট্রেনেই যাত্রী কমেছে। অনেকে জরুরি প্রয়োজনে যাত্রা করলেও তাদের উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বহু ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। এয়ার এরাবিয়ার চারটি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ইউএস বাংলা ও রিজেন্ট এয়ার কলকাতা এবং চেন্নাইয়ের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ বিমান সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে। যেসব ফ্লাইট চলাচল করছে সেগুলোতেও পর্যাপ্ত যাত্রী নেই। যাত্রী সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে।
বিষয়টি নিয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার এবিএম সারওয়ার ই জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফ্লাইট বন্ধ এবং কমে যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন রুটে যাত্রী কমে গেছে। মানুষ কম যাতায়ত করছেন।
শ্যামলী পরিবহনে প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে দেড় হাজারের মতো যাত্রী বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়ত করলেও এখন তা এক হাজারে নেমে এসেছে বলে দাবি করেছেন পরিবহন সংস্থাটির চট্টগ্রামের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ বাবুল আহমেদ। তিনি বলেন, যাত্রী সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। মানুষের কোনো মুভমেন্ট নেই। প্রতিটি বাসই স্বল্প সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে।
শুধু শ্যামলী পরিবহনই নয়, ঢাকাসহ দেশের নানা গন্তব্যে চট্টগ্রাম থেকে চলাচলকারী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং সাধারণ বাসগুলোর যাত্রী সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। বিষয়টি নিয়ে পরিবহন মালিকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, মানুষ ঘুরতে যাচ্ছেন না। বেড়াতে যাচ্ছেন না। সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
মানুষের মুভমেন্ট কমে যাওয়ার ব্যাপারটিকে শুধুমাত্র পরিবহন খাতের বিপর্যয় হিসেবে দেখতে নারাজ অর্থনীতিবিদরা। গতকাল দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, মানুষের মুভমেন্ট কমে যাচ্ছে। আরো কমে যাবে। কাজ না থাকলে মানুষ কোথায় যাবে? আবার সুস্থতার স্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকলে উদ্বিগ্ন মানুষ ঘরের বাইরে যাবে কেন? তিনি বলেন, সবকিছু মিলে মানুষের মুভমেন্ট কমে যাওয়ার ব্যাপারটিই আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে যে, বড় ধরনের এক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে দেশ। ভয়াবহ এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, কনোরাভাইরাস পুরো বিশ্বের মতো আমাদের অর্থনীতিতে বড় আঘাত হানতে শুরু করেছে। আমাদের উৎপাদন এবং রপ্তানিতে ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়েছে। যা আমাদের আমদানি সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। তিনি দেশের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ প্রবাসে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তাদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ কমে যাবে। চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি এবং ইউরোপের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমাদের রপ্তানি কমে যাবে। আমাদের ভাগ্য যেন চীন এবং ইউরোপের স্বাভাবিক থাকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীন যত তাড়াতাড়ি করোনাভাইরাসের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে, ইউরোপ যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আমাদের সবকিছুও ততই দ্রুত উন্নতি ঘটবে। অন্যথায় এই স্থবিরতা লাগাতার হলে পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠবে। তিনি গত বছর দেশের প্রবৃদ্ধি ৮.১৫ হলেও চলতি বছর তা কয়েক শতাংশ কমে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করে সরকারকে আসন্ন বিপর্যয় ঠেকানোর কর্মপন্থা এখনি জরুরি ভিত্তিতে ঠিক করার পরামর্শ দিয়েছেন।