মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে ঠাঁই হয়েছিল তার পরিবারের। আটকে পড়া পাকিস্তানি পরিবারের যুবক। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে ফেরত যায় পরিবারটি। এক যুগ আগে দেশটি থেকে ফের বাংলাদেশে ফিরে আসে তারা। আবার ক্যাম্পেই ঠাঁই নেয়। সাত সদস্যের পরিবারটির একজন রাজু ওরফে বাবা রাজু ওরফে পাকিস্তানি রাজু। এসব পরিচিতি পাওয়ার আগে তাকে ক্যাম্পে সবাই চিনত পানদোকানি রাজু নামে।

এই রাজু জেনেভা ক্যাম্পকে ঘিরে গড়ে তুলেছে ‘ইয়াবা সাম্রাজ্য’। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো ডিলার নিয়োগ দিয়ে দিনের পর দিন বিক্রি করে আসছে সর্বনাশা নেশার মাদক ইয়াবা। তার সিন্ডিকেটের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায় রাজু। এখন তাদের গোটা পরিবারই ইয়াবার কারবারে জড়িত বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজু কিংবা তার পরিবারের কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, একজন নারী এবং ছয়জন পুরুষসহ সাত সদস্যের এই পরিবারটি মোহাম্মদপুরের জেনেভা পাকা ক্যাম্পের রিয়াজের সাউন্ড দোকানের গলির একটি ঘরে বাস করছে। আর ক্যাম্পের বি ব্লকে পাঁচটি ঘর ভাড়া নিয়েছে রাজু। তবে রাজু কোথায় থাকে তা কারও জানা নেই।

জেনেভা ক্যাম্প সূত্র জানায়, পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর ভ্রমণভিসা নিয়ে ফের বাংলাদেশে আসে রাজুর পরিবার। জেনেভা ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা নূর ইসলাম ওরফে চারকু তাদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি বাসিন্দা হিসেবে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেন চারকু।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পাড়ি জমানোর আগে এই পরিবারটি পাকিস্তানে মাদক ব্যবসা ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। পরিবারের বড় সন্তান পাকিস্তানের ‘এলিট ফোর্স রেঞ্জার্স’ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। তাদের কর্মকাণ্ড পাকিস্তানে ফাঁস হয়ে গেলে তারা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশে এসে প্রথমে জেনেভা ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে একটি পান-সিগারেটের দোকানের ব্যবসা শুরু করে পরিবারটি। তবে এর আড়ালে চলত মাদক ব্যবসা। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে ইয়াবা ব্যবসার বিশাল সিন্ডিকেট। বর্তমানে সেই পান দোকান অন্য একজনকে ভাড়া দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নূর ইসলাম চারকু ও তার ছেলে ‘এস’ বাহিনীর সদস্য ইমরান ইয়াবার কারবারে রাজুর পরিবারকে সবরকম সহযোগিতা করেছে।

জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজুর আরও চার ভাই রাসেদ, কাসেম, আতিক ও হামজা এবং রাজুর স্ত্রী রিমা, রাসেদের স্ত্রী ঝিনু ও কাসেমের স্ত্রী চাঁদনিও ইয়াবা কারবারে জড়িত। তবে সবচেয়ে সক্রিয় রাজু ও তার মা রেহানা। ইয়াবা ব্যবসা করেই রাজু বর্তমানে চকবাজারে নিজের নামে একটি ফ্লাট কিনেছেন।

ইয়াবা কারবারের হিসাব রাখতে হাসান নামে একজন ম্যানেজারও নিয়োগ দিয়েছে রাজু। হাসান জুয়েলারির বাক্স তৈরির কাজের আড়ালে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসানের এই দোকানে বসেই ইয়াবার বড় বড় কারবার এবং ইয়াবা বিক্রির হিসাব নেন রাজুর বাবা ‘মান্ডা’ ওরফে ‘পাকিস্তানি মান্ডা’ ও রাজুর মা রেহানা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পের ইয়াবা গডফাদার হিসেবে পরিচিত ছিল পঁচিশ। র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গেল বছর মারা যায় পঁচিশ। তার মৃত্যুর পর জেনেভা ক্যাম্পের আরেক ইয়াবা কারবারি ইশতিয়াক চলে যায় আত্মগোপনে। রাজুর ছোট ভাইয়ের শ্বশুর ‘মেন্টাল আসলাম’ ইশতিয়াকের বোন জামাই। এ ছাড়া ধরা পরে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত মাদক কারবারি। সেসময় ক্যাম্প ছেড়ে যায় রাজু ও তার পরিবার।

অনুসন্ধান বলছে, রাজু বিভিন্ন সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে এবং নিয়মিত ঠিকানা পাল্টাচ্ছে। ক্যাম্প ছাড়ার পর পুরান ঢাকার নবাবপুরে তার আনাগোনা বেশি ছিল। এরপর ঘন ঘন জায়গা পরিবর্তন করে কখনো পুরান ঢাকায়, কখনো আদাবর, কখনো হাজারীবাগে রাজু বাস করে। সম্প্রতি মোহম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান মোড় এলাকায় স্থানীয় যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে রাজুর আনাগোনা দেখা গেছে।

রাজুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী রিমার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজের পরিচয় অস্বীকার করেন। এমনকি তার স্বামী রাজুকে চেনেন না বলেও এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন।

যেসব এলাকায় রাজুর ইয়াবার কারবার: মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকার প্রায় তিন শতাধিক ইয়াবা কারকারি রাজুর নিয়ন্ত্রণাধীন। তার দেয়া ইয়াবা বিক্রি করেন এসব ডিলার। তাদের মধ্যে অন্যতম আন্ডে, জাম্বু ওরফে কসাই জাম্বু, শাকিল ওরফে বাবা শাকিল, মাউরা রাসেল ও তার স্ত্রী, ওয়াসিম ওরফে ফরমা ওয়াসিম। এদের প্রত্যেকেই আটকে পড়া পাকিস্তানি আর জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তাদের ইয়াবা নেটওয়ার্ক রয়েছে জেনেভা ক্যাম্প, টোল ক্যাম্প, টাউনহল ক্যাম্প, জান্নাতবাগ ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায়।

কৃষি মার্কেট সংলগ্ন ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করছেন তুষার, সরফু, মজো বিকি, কালা চান, জাবেদ গাঞ্জা জাবেন, পাইজামা ওয়ালির ছেলে আরমান, নিহত ইয়াবা কারবারি পঁচিশের ভাই আরমান। ক্যাম্পের হুসেন পান দোকানের সামনে আর তাজমহল রোড ও ক্যাম্পের পেছনে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে তারা ক্রেতাদের হাতে ইয়াবা তুলে দিচ্ছে।

ক্যাম্পের সবাই জানে: রাজুর ইয়াবা কারবার ও সিন্ডিকেটের বিষয়টি জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সকলেই জানে। দীর্ঘসময় ধরে ইয়াবা ব্যবসা করে অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে রাজু। তাই তার কর্মকাণ্ডে অনেকে বিরক্ত হলেও মুখ খুলতে রাজি নন কেউ।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজুর উত্থান ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানিয়েছেন ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দা। জেনেভা ক্যাম্পের এক যুবক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাজু পান দোকান করত। তারপর ইয়াবা ব্যবসা শুরু করল। হুট করে টাকার মালিক হয়ে গেল।’

অপর এক বাসিন্দা বলেন, ‘শুধু ক্যাম্প না। ক্যাম্পের আশপাশে যত ইয়াবা সিন্ডিকেট আছে, সব রাজুর লোকজন। ওদের অনেক ক্ষমতা, তাই কেউ মুখ খুলতে পারে না।’

পঁচিশের মতো চিহ্নিত ইয়াবা কারবারির শাস্তি হওয়ায় খুশি ক্যাম্পের অনেকেই। তবে রাজুসহ অন্যান্য ইয়াবা ব্যবসায়ীদেরও উৎখাত করার দাবি ক্যাম্পবাসীর।

ক্যাম্পের অপর এক বাসিন্দা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ক্যাম্পের নামে নানা অভিযোগ। সবাই জানে আমরা ইয়াবা ব্যবসা করি। আসলে ক্যাম্পের লোকজন যারা ইয়াবা ব্যবসা করে, তাদের ইয়াবা বিক্রি ও খাওয়া শিখিয়েছে পাকিস্তানি রাজুরা। এদের নির্মূল করতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হবে।’

জেনেভা ক্যাম্পের নন লোকাল রিলিফ কমিউনিটি জোন-এ-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এস এম সিমা কোরাইশি। ক্যাম্পে রাজুর ইয়াবা সম্পৃক্ততার কথা তিনিও জানেন। ঢাকা টাইমসকে সিমা বলেন, ‘ওরা (রাজু ও তার পরিবার) আমাদের ক্যাম্পেই ছিল। এখান থেকে তারা পাকিস্তান চলে যায়। আবার কিসের জন্য ফুল (পুরো) ফ্যামিলি পাকিস্তান থেকে চলে আসছে। একটা রুম নিয়ে ওনারা এখানে থাকতেছে। আমার জানা মতে উনি এখন ক্যাম্পে নাই। আসে-যায় শুনেছি।’

রাজুর ইয়াবা ডিলারদের বেশিরভাগেই জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা এ বিষয়ে জানেন কি না প্রশ্নে সিমা বলেন, ‘এক সময় ছিল। এখন ওই রকম নাই। একেবারে নাই, আমি এটা বলব না। এটার ফুল (পুরো) দায়িত্ব থানার। আমাদের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে সহযোগিতা করছি।’

জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবার ঠেকাতে সক্রিয় হয়েছে ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন মহাজির রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট (এমআরডিএম)। সংগঠনটির সভাপতি ওয়াসি আলম বশির ঢাকা টাইমসকে জানান, প্রায় দশ থেকে বারো বছর আগে বাংলাদেশে আসার পর থেকে ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পরে রাজুর পুরো পরিবার। পান-সিগারেট বিক্রির দোকান থেকে রাজুর মা ও বাবা এই ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে। এরপর রাজু ও তার ভাইদের পাশাপাশি একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে রাজু ও তার ভাইদের স্ত্রীরা।’

ওয়াসি বলেন, ‘মাদকসহ হাতেহাতে এই পরিবারটি ধরার জন্য আমরা দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এরা খুবই চালাক। এই পরিবারকে ক্যাম্প থেকে বের করতে আমরা তাদের ঘরে তালাও দিয়েছিলাম।’

তথ্য না পাওয়া ও স্থান পরিবর্তনে অভিযানে সমস্যা: র‌্যাব

জেনেভা ক্যাম্পের ইয়াবা কারকারিদের বেশিরভাগে এখন ক্যাম্পের বাইরে রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আছে। র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘২০১৮ ও ২০১৯ সালে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। সাঁড়াশি অভিযানের পর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক যারা মাদক ব্যবসায়ী, যারা বিহারি এখন আস্তে আস্তে বাংলাদেশে স্থায়ী হয়েছে। তারা এখন আর ক্যাম্পে থাকে না। কারণ এরা অঢেল টাকাপয়সার মালিক হয়েছে আমাদের কাছে এমনও তথ্য আছে। পাশাপাশি তারা ক্যাম্পের আশপাশে, বিভিন্ন জায়গায় থাকে।’

জেনেভা ক্যাম্প থেকে তেমন তথ্য না পাওয়ায় এবং বারবার স্থান পরিবর্তন করার এ ধরনের মাদক কারবারিদের আইনের আওয়াত আনতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে জানিয়ে ফারুকী বলেন, ‘এদের আসলে অবস্থানটা কি আমরা জানার চেষ্টা করি। ক্যাম্প থেকেও আমরা তেমন তথ্য পাই না। আবার আমরা যখন হানা দিই, তখন দেখা যায়, তার পরিবার এখানে থাকে, সে থাকে অন্য জায়গায়।’

এর আগে ক্যাম্প থেকে দুই দফায় পাঁচ শতাধিক মাদক কারবারিকে আটক করা হয়েছে। এখনো যারা মাদকের কারবারে রয়েছে তাদের ধরতে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হবে জানিয়ে মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পকে ব্যবহার করেও অনেকেই মাদক ব্যবসা করে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এ্যাকশন প্লান করে আমরা অগ্রসর হব। বাইরে থেকে মাদক সরবরাহকারী তাদের চিহ্নিত করা, খুচরা ডিলার চিহ্নিত করা, যারা সেবন করে এবং ডিলার এদের চিহ্নিত করা। এই তিন ধাপে মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা নিব।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031