১৯৮৮ সালে আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। সে হিসাবে এই এক পেশাতেই পুরো ৩২ বছর হয়ে গেল। অন্য কোনো পেশায় হলে হয়তো এতদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে যেতে হতো। পেনশন নিয়ে বাকি জীবনের একটা হিসাব-নিকাশ করা যেত। কিন্তু এই পেশায় অবসরভাতা নেই, তাই অবসরের কথাও ভাবা যায় না। কাজ করে যেতে হয়, মুখ থুবড়ে পড়ার আগে পর্যন্ত। সেই থমকে যাওয়ার দিন যে দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে, তা বুঝতে পারছি। এত বছরের অভিজ্ঞতায় আজ অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে- এ দেশে মিডিয়ার বড় দুর্দিন এখন। সামনের দিনগুলোতে সাংবাদিকতার তেমন কোনো সুদিন আমি দেখি না।
মিডিয়ার দুঃসময় কেবল আমাদের দেশেই নয়, পুরো দুনিয়াতেই। বিশ্বখ্যাত অনেক বড় বড় মিডিয়া হাউস গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়িকভাবে সেগুলো আর টিকে থাকতে পারছিল না। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে মিডিয়াতে যতই আধুনিকতার ছাপ পড়ছিল, ততই যেন সাধারণ মানুষের মিডিয়ার প্রতি নির্ভরতা কমছিল। প্রযুক্তি বিপুল সংখ্যক মানুষের সামনে হাজির করছিল বিকল্প ভার্চুয়াল মিডিয়াকে। মানুষ এখন আর টাকা দিয়ে পত্রিকা কেনে না, বরং ইন্টারনেটের ডাটা কেনে। ইন্টারনেট থাকলে কেবল একটিই নয়, সকল পত্রিকাই পড়া যায়। এমনকি বিদেশের পত্রপত্রিকাও হাতের মুঠোতে চলে আসে। সিরিয়াস খবর আসে, সেই সঙ্গে আসে বিনোদনও। ট্রাডিশনাল মিডিয়া যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়াও। সবকিছু একটি মাত্র ক্লিকের দূরত্বে। আজকাল আবার ক্লিকও লাগে না, মুখে কেবল উচ্চারণ করলেই হয়, গুগল সেটা বুঝে নিয়ে যা চাই সব এনে হাজির করে। এ যেন আলাদিনের সেই দৈত্য। আলাদিনকে ঘষতে হতো প্রদীপ, আর আমাদের আঙুল বুলাতে হয় মুঠোফোনের স্ক্রিনে।
তাহলে মানুষ আর টাকা খরচ করে পত্রিকা কিনবে কেন? কেন সন্ধ্যার পর হাতে এক কাপ চা নিয়ে ড্রয়িং রুমে টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসবে দিনের খবরগুলো দেখতে? পত্রিকার মতো টেলিভিশনও এখন সহজলভ্য ওই ইন্টারনেটে। কোনো দেশি বা বিদেশি খবর পেতে আপনাকে এখন আর টেলিভিশনের খবরের জন্য নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। নেটের দুনিয়ায় সবসময়ই তা ভেসে বেড়াচ্ছে, যখন ইচ্ছা তখনই দেখতে পারবেন। এই সহজ সুযোগ না নিয়ে কেন মানুষ টেলিভিশনের খবরের জন্যই বা অপেক্ষা করবে?
আবার যদি এমন হতো, প্রকৃত ঘটনাটি কী ঘটেছে তা কেবল ওই পত্রিকা বা নির্দিষ্ট একটি টেলিভিশনের সংবাদেই পাওয়া যাবে, তাহলে হয়তো কেউ কেউ অপেক্ষা করতো তার জন্য। সেটাও কি হচ্ছে বাস্তবে? কোনো কোনো দেশে হয়তো হয়, কিন্তু আমাদের দেশে যে হয় নাÑ তা বলা যায় হলফ করে। এখানে সবাই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসায়। অথবা বলা যায়, গা ভাসাতে বাধ্য হয়। এখানে বিপরীত স্রোতে চলার কোনো সুযোগ নেই। বিপরীত স্রোতে চলতে গেলে বিপদ অনিবার্য। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের হাজারো উপায় এখন এই দেশে বিরাজ করছে।
সরকার এবং তার মন্ত্রীরা প্রায়ই তারস্বরে বলে থাকেন যে, আমাদের দেশে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন মিডিয়াগুলো এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। কিন্তু সে কথাটিকে মানুষ খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে বলে মনে হয় না। দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমার নিজেরও তা মনে হয় না। তারপরও সরকার যেহেতু বলেন, সরকার যেহেতু ক্ষমতাবান, তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের সে দাবির তেমন একটা প্রতিবাদও হয় না।
আমি দীর্ঘদিন, টানা দশ বছর একটা বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করেছি। কাগজে-কলমে না হলেও, সবাই জানত এই টেলিভিশনটির মালিকানার সঙ্গে বিএনপি দলীয় নেতারা জড়িত। কাজ করতে গিয়ে আমি নিজেও তা জেনেছি। টেলিভিশনটি লাইসেন্স পায় বিএনপি আমলে। বিএনপি আমলে আওয়ামীপন্থী লোকজনের পক্ষে টিভির লাইসেন্স পাওয়া সহজ বিষয় ছিল না, কেউ তেমন পেয়েছে বলে জানাও নেই। অথচ সরকার পরিবর্তনের পর দেখা গেল মালিকানায় নাম থাকা সেই লোকগুলোই মহাআওয়ামী লীগ হয়ে গেল। বলে বেড়াতে লাগল- উত্তরপাড়ার সঙ্গে তাদের কার কত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সেই কল্পকাহিনি। মাঝে মাঝে আজগুবি সব বিষয় আসত, প্রচার করতে হবে, কারণ ‘ওপর’ থেকে আদেশ এসেছে। কাউকে বাদ দিতে হবে, ‘ওপর’ এর নামে সেটাও চালিয়ে দেওয়া হতো। শেষ অবধি এমনও দেখা গেল, নিউজের হেড থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত, চাকরি যাচ্ছে সেই ‘ওপর’ এর অজুহাতে। মহাপরাক্রমশালী ‘ওপর মহল’ যে সামান্য একজন পিয়নের চাকরি নিয়েও এতটা চিন্তিত থাকে, তা এই মালিকগোষ্ঠীর কথা না শুনলে বোঝার উপায় ছিল না!
সরকারের চাপ তো আছেই, কিন্তু সেই সঙ্গে সরকারের নাম করে পেশার সঙ্গে সম্পর্কহীন মালিকদের চাপ আরও অনেক বেশি ক্ষতি করছে আমাদের মিডিয়াকে। সাংবাদিকতার পেশাদারত্ব প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হয়েছে এই অশিক্ষিত ব্যবসায়ীদের কাছে। এদের একটা বড় অংশ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু মিডিয়ার মালিক হিসাবে তারা একধরনের দায়মুক্তির দাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্যে। এই মালিকদের গাড়ি, বাড়ি, এমনকি তাদের অন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের গাড়িতেও লাগানো থাকে তাদের মিডিয়ার স্টিকার। ফলে কুরিয়ার, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিকস কিংবা ওষুধ কোম্পানির গাড়িতেও দেখা যায় বড় বড় করে মিডিয়ার নাম লেখা। কোনো এক ভূমি ব্যবসায়ী হয়তো বিশাল এক জমির ওপর তার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চান, দেখা গেল সেখানে বড় করে একটা মিডিয়ার নাম ঝুলিয়ে দিয়েছেন! জিন তাড়ানো তাবিজের মতো এই সাইনবোর্ড তার জমিকে রক্ষা করে। তারা আসলে মিডিয়াকে নিজেদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যবহার করে। ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের কাজে ব্যবহার করা যায় বলে অনেকেই নানা কৌশলে মিডিয়ার মালিকও হয়ে যাচ্ছেন। তারপর একটা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড জোগাড় করে ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে ঢুকে যাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ে, করছেন নিজের এবং নিজেদের জন্য নানা ব্যবসায়ের তদবির। ফলে সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকের কাছে থাকছে না। সাংবাদিকতার সুফলও যাচ্ছে না জনগণের কাছে। আপনি সাংবাদিক, জনগণ যা জানতে চায়, দেখতে চায়, তা আপনি প্রচার করতে পারবেন না। সরকার বা মালিক যা চায়, সেই অনুযায়ী আপনাকে কাজ করতে হবে। সাংবাদিকের কোনো স্বাধীনতা নেই, সাংবাদিকতারও কোনো স্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতা যতটুকু যা আছে, সেটা বরং মালিকের। মালিক মিডিয়াকে ব্যবহার করে তার সুবিধা অনুযায়ী।
কিন্তু মিডিয়ার ভূমিকা কি এরকম হওয়ার কথা ছিল? মিডিয়াকে বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। কোনো দেশে যদি স্বাধীন, পেশাদার ও দায়িত্বশীল মিডিয়া থাকে, ধরে নেওয়া হয় সেখানে আর কিছু না হোক একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে। মিডিয়ার অবস্থা দেখে ধারণা করা যায় সেখানে গণতন্ত্র কতটা আছে বা নেই। কিন্তু ওই যে বললাম স্বাধীন, পেশাদার ও দায়িত্বশীলÑ এর কোনো বৈশিষ্ট্যটি আছে আমাদের মিডিয়ার? আমাদের মিডিয়া কি স্বাধীন? অত খুঁটিনাটি উদাহরণের দিকে না তাকিয়ে মাত্র দুটি বিষয় বলা যায়। দেশের প্রতিটি বেসরকারি টেলিভিশনকেই সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিভির দুপুরের খবরটিকে বাধ্যতামূলকভাবে সম্প্রচার করতে হয়। গণতান্ত্রিক কোনো দেশে এরকম উদাহরণ আছে কি না, বলা মুশকিল। আবার যদি ধরা হয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণগুলো প্রত্যেক টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করার বিষয়টি, তার মাধ্যমেও মিডিয়ার স্বাধীনতা কতটুকু প্রতিফলিত হয়- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আচ্ছা, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কি চান যে ছোটখাটো অনুষ্ঠানে দেওয়া তার ভাষণগুলোও এভাবে প্রতিটি টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট হোক? নাকি ওই অতি উৎসাহীদের দাপটেরই প্রতিফলন এসব? পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইদানীং ‘গদি মিডিয়া’ বলে একটা বিশেষণ খুব ব্যবহার হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, সেখানে বেশ কিছু মিডিয়া রয়েছে যেগুলো নানা ইস্যুতে, নানা অজুহাতে, কেবলই মোদি সরকারের গুণগান করে। ওই ‘গদি মিডিয়া’র কাছ থেকেও কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী এতটা পক্ষপাতমূলক ভালোবাসা পান না।
কেবল সরকারের কথাই বা বলি কেন, মালিকানার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা যদি কোনো ব্যবসায়িক অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হন, কোনো পরিচালকের পুত্র যদি নকল ওষুধের ব্যবসা করতে গিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরাও পড়েন, সেটা কি সংশ্লিষ্ট ওই মিডিয়া প্রচার করতে পারে? একটি নামকরা রেস্টুরেন্টের কিচেনে একবার মরা ইঁদুর পাওয়া গেল। সে খবর পরদিন দেশের বেশিরভাগ পত্রিকায় এলো। কিন্তু ওই রেস্টুরেন্টের মালিকানা গ্রুপের একাধিক পত্রিকা বিষয়টি একেবারেই চেপে গেল। একে কি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বলা যাবে? এভাবে পরাধীনতার ব্যাপ্তি কি ক্রমশ বাড়ছেই না? একই রকম শত শত উদাহরণ দেওয়া যায় সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার অনুপস্থিতি সম্পর্কে।
এই যদি হয় সাংবাদিকতার চেহারা, তাহলে মিডিয়ার বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশে পত্রিকার পাতায় আর টেলিভিশন সংবাদে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বেÑ এমন প্রত্যাশা নিশ্চয়ই যৌক্তিক হবে না। ফলে পাঠক কমছে, দর্শক বিমুখ হচ্ছে। মানুষ ঝুঁকছে অনলাইন আর সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে। যেহেতু পাঠক আর দর্শকরা দিক পরিবর্তন করছে, তাই অবধারিতভাবে বিজ্ঞাপনদাতারাও তাদের টার্গেট গ্রুপকে অনুসরণ করছে। পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে অনলাইনে। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব খুললেই এখন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন। এসব তো আগে পত্রিকা বা টিভিতেই ছিল। কিন্তু এখন নেই। বিজ্ঞাপনের এই স্থান পরিবর্তন বাড়ছে প্রতিনিয়তই। ফলে আয় কমছে মিডিয়ার। সংকট মোকাবেলায় অনভিজ্ঞতার কারণে ব্যবসায়ী মালিকরা সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যাচ্ছে তারা শর্টকাট পথে। আয় কমেছে, তাই চেষ্টা করছে ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে। ছাঁটাই করছে সাংবাদিককে। লোকবল কমায় মান নেমে যাচ্ছে পেশার। সাংবাদিকতা পরিণত হচ্ছে তোষামোদি আর তৈলমর্দনের শিল্পে। জনগণ সে সব প্রত্যাখ্যান করছে, প্রতিষ্ঠান পড়ছে আরও বেশি জটিলতায়। এ যেন সংকটের এক অনতিক্রান্ত বৃত্ত।
এ বৃত্ত থেকে বের হওয়ার কোনো প্রচেষ্টাও যে মিডিয়া জগতে খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে, তেমন বলা যাবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য এখানে। হতাশাটাও এ কারণেই।
মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক