২০১৭ সালে দেশটির সরকারের সৌদিকরণ নীতি গ্রহণের কারণে দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন তারা। বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। এসব কর্মীরা দেশটির বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। নতুন করে আকামা নবায়ন হচ্ছে না। ওই নীতি অনুসারে দেশটির ৩৯টি খাতে প্রবাসী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। গত বছর থেকে বিদেশি কর্মীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটি। এর আওতায় দেশটিতে অবস্থানরত অর্ধেক বাংলাদেশি-ই কাজ করার সুযোগ হারাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এসব কর্মীদের জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এক শ্রেণির দালালচক্র প্রতারণার মাধ্যমে লোক পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। ফলে, তারাও এর শিকার হচ্ছে। সর্বস্ব খুঁইয়ে দেশটিতে কাজের সন্ধানে গিয়ে অনেকেই স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির বিভিন্ন পেশায় বিদেশিদের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা ও প্রবাসীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স /ফি আরোপের কারণে বর্তমানে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিরা খুবই দুরাবস্থায় রয়েছে। অনেকে বর্ধিত ফি দিয়ে আকামা করতে না পেরে অবৈধ হয়ে পড়ছে এবং সৌদি পুলিশের হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। অপরদিকে, ফ্রি ভিসায় আগত শ্রমিকরা কফিল ও কাজ খুঁজে না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন শেষে নিঃস্ব হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করছে। ফ্রি ভিসায় আগত শ্রমিকদের অর্থের একটি বড় অংশ সৌদি পাচার হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দায়ী সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সৌদি সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সৌদিকরণ নীতি গ্রহণের ফলে অনেক প্রবাসী বেকার হয়ে পড়ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে সৌদি সরকার ঘড়ি, চশমা, হাসপাতাল সামগ্রী, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎচালিত সামগ্রী, গাড়ির যন্ত্রাংশ, আবাসন উপকরণ, কার্পেট, গাড়ি ও মোটরসাইকেলের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, গৃহ ও অফিস আসবাবপত্র, বাচ্চাদের কাপড় ও পুরুষদের আনুষঙ্গিক জিনিস, গৃহস্থালি তৈজসপত্র এবং কনফেকশনারি দোকান- এই ১২টি পেশায় প্রবাসীদের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই বছরের মার্চে শ্রম মন্ত্রণালয় এরকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরও ৮টি পেশায় প্রবাসী নাগারিকদের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এগুলো হলো- ট্রাক ও লরি ড্রাইভার, জীবন বীমা কোম্পানি ও ডাক যোগোযোগ, বেসরকারি গার্লস স্কুলের কর্মকর্তা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শপিংমলে নিয়োগ। সর্বশেষ একই বছরের এপ্রিল মাসে আরও একটি প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়। এতে সিনিয়র মানবসম্পদ কর্মকর্তা, কর্মী পরিচালক, শ্রম বিষয়ক পরিচালক, জনসংযোগ কর্মকর্তা, কর্মী ব্যবস্থাপক, কর্মচারি ডিউটি লেখক, নিয়োগ বিষয়ক কর্মকর্তা-কর্মচারি, স্টাফ লেখক, টাইম রেজিস্ট্রার সংরক্ষক, জেনারেল রিসেপশনিস্ট, হোটেল রিসেপশনিস্ট, রোগী রিসেপশনিস্ট, বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অভিযোগগ্রহণকারী, কোষাধ্যক্ষ, নিরাপত্তারক্ষী, সরকার সম্পর্কিত কর্মকর্তা, চাবি তৈরি/মেরামতকারী, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারি ও নারী সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগে প্রবাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। পাশাপাশি ওই সময়ে আকামা ফিও বাড়ানো হয়। ফলে চাকুরি হারিয়ে অনেক বাংলাদেশি দেশে আসতে বাধ্য হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ৫০ শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের আকামার মেয়াদ নেই। ফলে তারা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। এরা প্রতিনিয়তই পুলিশের হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরছেন। এছাড়া আকামার ফি পরিশোধের লক্ষ্যে অনেক প্রবাসী কম বেতনে ব্যবসাসহ বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। সৌদি আরবের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, আকামার নির্ধারিত পেশা ব্যতিত অন্য পেশায় কাজ করা দ-ণীয় অপরাধ। এর ফলে আকামার মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও তাদের পুলিশ ধরে ফেরত পাঠাচ্ছে। নির্ধারিত ৮ ঘণ্টা কাজ শেষে অন্য জায়গায় বাড়তি কাজ করতে গিয়েও অনেকে আটক হচ্ছেন।
দেশটির অর্থনৈতিক মন্দা এবং সৌদিকরণ নীতির ফলে বর্তমানে দেশটিতে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এরপরও কিছু অসাধু আদম ব্যবসায়ী সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও কনস্যুলেটের প্রত্যয়ন ছাড়াই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থার মন্ত্রণালয় থেকে ভিসা এটেস্টেশন করে হাজার হাজার লোককে সৌদি আরবে প্রেরণ করছে। এ সকল শ্রমিকদের অধিকাংশই কফিলকে খুঁজে না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশেষ করে ফ্রি ভিসায় গমনকারী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ফ্রি ভিসা বলতে কিছু নেই।
প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশও করা হয়। বলা হয়- দেশটিতে শ্রমিক পাঠানোর আগে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক কাজের পরিবেশ, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য বিষয়াদির খোঁজ-খবর নেয়া এবং এ বিষয়ে দূতাবাসের প্রত্যায়নপত্র অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে। যেসব ট্রাভেল এজেন্সি সরকারের আইন, গাইড লাইন ভঙ্গ করবে বা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। ইতিমধ্যে যেসব এজেন্সির শ্রমিকরা সৌদি আরবে গমণ করে বিপদগ্রস্ত হয়ে দেশে ফেরত আসছে সেসব এজেন্সিকে কালো তালিকাভুক্ত করে লাইসেন্স বাতিল করা যেতে পারে। সৌদি আরবে প্রবাসীদের বর্তমান দুরাবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সচেতন করা। বিশেষ করে ফ্রি ভিসায় যাতে কেউ না যেতে পারে সে বিষয়ে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ সকল বিষয়াদি উপস্থাপনপূর্বক সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সৌদি সরকারের আরোপিত বিভিন্ন বিধি-নিষেধ ও ট্যাক্স হতে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৬৩৫ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১৯৫৯ জন সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৩০০ নারীকর্মী রয়েছেন। আর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে মোট ৬৪ হাজার ৬৩৮ কর্মী দেশে ফিরেছেন যাদের পরিচয় ডিপোর্টি। এদের মধ্যে ২৫ হাজার ৭৮৯ জনই ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ফেরত আসা এই প্রবাসীদের পাশে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সবার সমন্বিতভাবে দাঁড়ানো উচিৎ। পাশাপাশি এভাবে যেন কাউকে শূন্য হাতে ফিরতে না হয় এবং প্রত্যেকে যেন কাজ পায় এবং কাজের মেয়াদ শেষে খরচের টাকাটা অন্তত তুলতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সি, দূতাবাস ও সরকার সবাই মিলে এই কাজটি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।