চালক আর কন্ডাক্টরের কাছে জিম্মি বাসভর্তি মানুষ। যাত্রীর অসহায় চিত্র প্রতিটি পরিবহনে। নৈরাজ্য আর অনাচার নিত্যসঙ্গী রাজধানীর বাস যাত্রীদের।ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো বালাই নেই। চার্ট টাঙানোর নিয়ম থাকলেও কোনো পরিবহনেই তা নেই। আর থাকলেই কী? চার্ট অনুযায়ী আদায় হয় না ভাড়া। ফার্মগেট থেকে আসাদ গেট গেলেও ভাড়া ১৫টাকা। আবার মিরপুর গেলেও সেই ১৫ টাকা।
এক কিলোমিটার গেলেও একই ভাড়া। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে গেলেও একই ভাড়া। এ এক অন্যরাজ্য। যে রাজ্যে আইন কানুন বলতে কিছুই নেই। কিলোমিটারের হিসাব হারিয়ে গেছে রাজধানীর বাসগুলো থেকে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে স্টপেজ হিসাবে ভাড়া আদায়। এ নিয়ে কোন যাত্রী কিছু বললেই কন্ডাক্টরের স্বদোক্তি- মালিকের কথায় বাস চলে না। ভাড়া দেন। যেখানেই যাবেন ১৫ টাকাই দিতে হবে। গতকাল বিহঙ্গ বাসের চিত্র এটি। এক যাত্রীকে এভাবেই বলছিলেন বাসের কন্ডাক্টর। ফার্মগেট থেকে মিরপুর কাজীপাড়া যাবেন ওই যাত্রী। প্রায় ৫ কিলোমিটার এই দূরত্বের সরকারের নির্ধারিত বাস ভাড়া ৯ টাকা। তিনি ১০ টাকা ভাড়া দিলেবাস কন্ডাক্টর ক্ষেপে গিয়ে এ কথা বলেন।
পরিবহন খাতে এখন সবচেয়ে বড় নৈরাজ্য চলছে ভাড়া নিয়ে। আর সিটিংয়ের নামে চিটিংবাজিতো আছে। এমন কোন বাস নেই যেখানে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছেনা। বাস ও মিনিবাসের ভাড়া সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৫ থেকে ৭ টাকা হলেও এ চার্ট মানছেন না বাস মালিকরা। ফার্মগেট থেকে কোন বাসে গুলিস্থান গেলে ১০ টাকা। আবার শাহবাগ গেলেও ১০টাকা। অন্যদিকে প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগ এলেও ১০ টাকা। বাংলামটর, কাওরান বাজার এবং ফার্মগেট গেলেও ১০ টাকা। আবার ফার্মগেট থেকে মিরপুরের ভাড়া ১৫ টাকা। কিন্তু পথে যেখানেই যাত্রী নামবেন তাকে ১৫ টাকা দিয়েই নামতে হবে। অন্যথায় হতে হবে হেনস্থা। শুধু তাই নয়, নানা অজুহাতে অঘোষিতভাবে ভাড়া বাড়াচ্ছে যখন তখন।
রাস্তায় যাত্রীর আধিক্য দেখলেও ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। ১০টাকার জায়গায় ২০ টাকা। ১৫ টাকার জায়গায় ৩০টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত বাস কন্ডাক্টারদের সঙ্গে চলছে যাত্রীদের বাকবিতন্ডা। মতিঝিল থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার এ রুটে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। পল্টন থেকে শাহবাগ ২ কিলোমিটার রাস্তায় বাসের বাড়া আদায় করছে ১০ টাকা। মতিঝিল থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দূরত্ব ৮.২ কিলোমিটার। ভাড়া আসে ১৩ টাকা। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। পল্টন-মিরপুর রুটে, শিখর, খাজাবাবা, বিকল্প অটো সার্ভিস, বিহঙ্গসহ প্রায় সকল বাসে একইচিত্র। সরজমিনে বিভিন্ন রুট ঘুরে দেখা যায়, গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, গাবতলী বা যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ রুটসহ প্রতিটি রুটেই বাস যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিভিন্ন বাসে কন্ডাক্টরদের কাছে বর্ধিত ভাড়ার চার্টও দেয়া হয়েছে। তাতে সরকারি কোনো দপ্তরের সিল স্বাক্ষর নেই। সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির সিল স্বাক্ষরযুক্ত ওই ভাড়ার চার্টে দেখা যায়, মালিকরা নির্ধারিত কিছু স্টপেজ ধরে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মধ্যবর্তী যাত্রীরা নির্ধারিত সেই স্টপেজ থেকে বাসে ওঠা-নামা না করলেও মালিক নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। বাস-মিনিবাসের গায়ে পরিবহন কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধামতো ‘স্পেশাল সার্ভিস’ ‘কম স্টেপেজ’ ‘গেটলক’ ‘ননস্টপ’ ‘বিরতিহীন’ ইত্যাদি লেভেল সেঁটে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। নিয়ম মাপিক ভাড়া আদায় করছে না কেউ। সায়েদাবাদ থেকে বাড্ডার দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। মিনিবাসে এ দূরত্বে ভাড়া আসে প্রায় ১৫ টাকা। এই রুটে তুরাগসহ সব কয়টি বাস ভাড়া আদায় করছে ২০ টাকা। খিলক্ষেত থেকে শাহবাগের ভাড়া ১৫ টাকা, আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। একইভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে যাত্রাবাড়ী রুটে। একই দূরত্বে রাইদা, ছালছাবিল ও অনাবিল বাসে আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। গুলিস্তান থেকে বাড্ডা পর্যন্ত সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিসে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৩০ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা। কিলোমিটার হিসেবে নয়, স্টপেজ হিসেবে ভাড়া আদায় করছেন তারা।
বাসযাত্রী মাজহারুল ইসলাম রুমন বলেন, পরিবহন খাতে এখন ডাকাতি হচ্ছে। আমাদের মত সাধারন মানুষের পকেট কেটে তারা টাকা নিচ্ছে। এমন একটা দেশে বাস করছি, যেখানে ২ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে ১৫ টাকা বাস ভাড়া দিতে হয়। সিটিং কোন বাস নেই। প্রতিবাসে ৩৮/৪০ জন যাত্রী উঠানোর কথা থাকলেও বাস কানায় কানায় পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত যাত্রী উঠানোই হয়। আরেক যাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মামুন জানান, এই রুটে বিহঙ্গ ছাড়া কোন বাসে হাফ পাশ কাটে না। ক্লাসে লেট হওয়ার ভয়ে অনেক সময় বিকল্প, আয়াত, খাজা বাবাসহ বিভিন্ন বাসে উঠি। তারা হাফ ভাড়া তো কাটছেইনা। বরং বিভিন্ন ভাবে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করতে থাকে। অনেক সময় হাতে বই খাতা থাকলে বাসে উঠাতে চায় না।
বিহঙ্গ বাসের কন্ডাক্টর রেজা জানান, সর্বনিম্ন ৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা থাকলেও ১০ টাকার নিচে ভাড়া নেয়া হয় না। এটা মালিকরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। গুলিস্তান থেকে পল্টন, শাহবাগ ও বাংলামোটর হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত যেখানেই নামেন ভাড়া ১০ টাকা। ফার্মগেটের পর মিরপুর-১২ পর্যন্ত যে কোনো স্টপেজে যান ভাড়া ১৫ টাকা দিতে হবে। আগারগাঁও পর্যন্ত ৪ কিলোমিটারের ভাড়াও ১৫ টাকা দিতে হবে। ওয়েবিল খাতায় লিখে দেয় যাত্রী সংখ্যা। তাই ১৫ টাকাই আমাদের নিতে হয়। ভাড়ার র্চাট নিয়ে তিনি বলেন, এটা তো মালিকরা জানে। আমাদের কিছু করার নাই। এটা কোন কাজে আসে না। বাস সমিতির লোকেরা লাগিয়ে দিয়েছে।