পিয়াজের ভরা মৌসুম। দেশি-বিদেশি পিয়াজে ভরপুর পাইকারি ও খুচরা বাজার। সরবরাহ ব্যাপক। রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লায়ও ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে এই নিত্যপণ্যটি। ফলে ঊর্ধ্বমুখী থাকা পিয়াজের বাজার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবারো অস্থির হয়ে ওঠে। গত তিন দিনের ব্যবধানে এর দাম বেড়েছে কেজিতে ১০০ টাকার বেশি। গত বুধবার প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা।
শনিবার বেড়ে পণ্যটি আবার ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ হাঁকিয়েছে। রাজধানীর বাইরেও লাগামহীন দামে বিক্রি হয় পিয়াজ। কেন হঠাৎ করে পিয়াজের দাম বাড়লো যুক্তিক কোনো জবাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে বৃষ্টি ও বৈরি আবহাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বাজারে পিয়াজের দাম বেড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এছাড়া আমদানি সঙ্কটের পাশাপাশি বাজারে দেশীয় জাতের পিয়াজের সঙ্কট থাকায় দাম বেড়েছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নানা অজুহাতে পিয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত বছর থেকেই এ দাম বাড়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে। সরকারের নানা উদ্যোগে দাম কমতে থাকলেও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করার জন্য আবারও দাম বাড়াচ্ছে। যা কোনোভাবে অযৌক্তিক না। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকা উচিত। আর দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে এবার শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে দাম ভোক্তা সহনীয় করতে হবে।
এদিকে একদিনের ব্যবধানে দাম কমেছে পিয়াজের। গতকাল কাওরানবাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা, পাকিস্তানি পিয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, মিশরের পিয়াজ ৭৫ টাকা এবং চীনা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, বৈরি আবহাওয়ায় সরবরাহ ঘাটতির কারণে দাম বেড়েছিল। এখন সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে। দেশের প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে হঠাৎ করে পিয়াজের দাম কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে যায়। তবে আড়তদাররা জানান, আমদানি কমে যাওয়ায় পিয়াজের দাম বাড়ছে।
এর আগে গত বছরের ১৪ই নভেম্বর দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ২০০ টাকায় বিক্রি হয়, যা পরে ২৬০ টাকায় পৌঁছায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর দাম সর্বোচ্চ প্রতি কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। পরে আমদানি বাড়ায় ও দেশি পিয়াজ বাজারে আসায় দাম কিছুটা কমে আসে। দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকায় নেমে আসে। গত সোমবার থেকে লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হয়। এতে পিয়াজসহ শীতের সবজির ক্ষতি হবে- এমন আশঙ্কায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা আবার দাম বাড়াতে শুরু করেছেন। এর প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারেও।
পিয়াজের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে শ্যামবাজার বণিক সমিতির সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, পিয়াজ তোলার পর রোদে শুকাতে হয়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে তেমন একটা রোদ উঠছে না। এ ছাড়া বৃষ্টিতে পিয়াজ ক্ষেতে পানি জমে কিছু পিয়াজ নষ্টও হয়েছে। সব মিলিয়ে কয়েক দিন ধরে বাজারে পিয়াজ নেই; যা আছে সেগুলোর দামও অনেক বাড়তি। আশাকরি নিয়মিত রোদ উঠলে সরবরাহ বাড়বে। দামও কমবে। তবে আমদানি পিয়াজের দাম তেমন একটা বাড়েনি।
রাজধানীর শ্যামবাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৪০ টাকা, যা আগে ছিল ১২০-১৩০ টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে প্রকার ও বাজারভেদে দেশি পিয়াজ ১৭০-২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেও এসব পিয়াজের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০০-১২০ টাকা। চীন-মিসরের বড় পিয়াজ প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫০-৬০ টাকা। এ ছাড়া পাইকারিতে আমদানি করা মিসরের পিয়াজ বিক্রি হয় ৭৫-৮০ টাকা ও চীনা ৬০-৬৫ টাকা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সার্বিকভাবে বাজার তদারকি করা হচ্ছে। দিনে দুটি টিম অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার তদারকি করছে। দাম বাড়ার পেছনে অনিয়ম পেলে ভোক্তা আইনে শাস্তির আওতায় আনা হবে। কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।
রাজধানীর পিয়াজের পাইকারি আড়ত কাওরান বাজার ঘুরে পিয়াজের কোনো সংকট দেখা যায়নি। বরং প্রতিটি গুদামে পিয়াজের বস্তা থরে থরে সাজিয়ে রাখতে দেখা গেছে। আড়তদাররা জানান, গত বুধবার প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ পাইকারিভাবে বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮০ টাকা। যা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ৮৫-৯০ টাকা। শুক্রবার কেজিতে ৮০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয় ১৭০ টাকা। আর শনিবার কেজিতে আরো ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা। এ ছাড়া আমদানি করা চীনা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬৫ টাকা। যা তিন দিন আগে বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকা। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ায় খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।
রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে পিয়াজের কোনো ধরনের সংকট দেখা যায়নি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি আড়তে পিয়াজে ভরপুর। কিন্তু সংকটের কথা বলে বেশি দামে বিক্রি করছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, তিন দিন আগে দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০-১২০ টাকা। যা শনিবার বিক্রি হয় ১৯০-২০০ টাকা। এ ছাড়া চীনা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮৫-৯০ টাকা। যা তিন দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা।
খুচরা পিয়াজ বিক্রেতা নয়ন মিয়া বলেন, কয়েক দিন পরপর পাইকারি বিক্রেতারা পিয়াজের দাম বাড়ায়। আবার সময় সুযোগমতো মুনাফা করে দাম কমায়। কিন্তু আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে আনলে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। কম দামে পেলে কম দামেই বিক্রি করি। এখানে দাম বাড়ার সঙ্গে আমাদের কোনো হাত নেই।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে টিসিবির মাধ্যমে ৩৫ টাকা দরে পিয়াজ বিক্রি অব্যাহত আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে পিয়াজ আমদানি হচ্ছে। দেশের উৎপাদিত পিয়াজ বাজারে এসেছে। কিন্তু এর পরও দাম ভোক্তার নাগালে আসছে না। বরং তিন দিনের ব্যবধানে বৈরি আবহাওয়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা নিত্যদিনের এ পণ্যটির দাম আবারও বাড়িয়েছে।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, বর্তমানে প্রতি ট্রাকে ৩ টন করে পিয়াজ দিচ্ছি। দামও কমিয়েছি। প্রয়োজন হলে ট্রাক আরো বাড়ানো হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।