২২৬ বছরের ইতিহাস। ১৭৯৩ থেকে ২০১৯ সাল। সরকারের কাজ করলেও বেতন পেতেন না সরকারি কর্মচারীদের নিয়মে। রাতদিন কর্তব্য পালনে নিয়োজিত থেকে ছয় হাজার টাকা পেতেন, যার অর্ধেক দিত ইউনিয়ন পরিষদ। ফলে সামাজিক কোনো অবস্থান ছিল না তাদের। একরকম দাসত্বের শৃঙ্খলে জড়িয়ে ছিলেন এই গ্রামপুলিশ পেশা।
অবশেষে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে মর্যাদা পেলেন গ্রামপুলিশ তথা ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার ও মহল্লাদাররা। সর্বশেষ সরকারি বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন পাবেন তারা ২০ হাজার টাকার বেশি। থাকছে পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধা। প্রতিটি ইউনিয়নে মোট জন করে দেশে মোট দফাদার ও মহল্লাদার রয়েছেন ৪৭ হাজার। হাইকোর্টের এক রায়ে তাদের দাসত্ব ঘুচল। তাদের হয়ে আইনি লড়াই করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। ঢাকা টাইমসের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি তুলে ধরেছেন গ্রামপুলিশের ২২৬ বছরের বঞ্চনার ইতি টানার লড়াইয়ের গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিনুল ইসলাম মল্লিক।
ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব: ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রামপুলিশের একটি অংশের সঙ্গে সমঝোতায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দিতে রাজি হয়। ওই বছরই গ্রামপুলিশ তাদের বেতন-ভাতার জন্য প্রস্তাব পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। তিন-চারবার এই প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা নাকচ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, এই দফাদার ও চৌকিদার পাকিস্তান আমল থেকে একই নিয়মে চলে আসছে। নতুন করে চতুর্থ শ্রেণির মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজন নাই।
এরপর ২০১৭ সালে তারা হাইকোর্টে আসেন মামলা করতে। অনেকের কাছে ঘুরে শেষ পর্যায়ে আমার কাছে আসেন ধামরাইয়ের লাল মিয়াসহ সারা দেশের চৌকিদার ও দফাদারদের প্রতিনিধিরা। আমি বিষয়টি মানবিক বিবেচনা করে তাদের জন্য হাইকোর্টে রিট করি।
ঢাকা টাইমস: দফাদার-মহল্লাদার তথা গ্রামপুলিশের সূচনা তো বহুকাল আগে। তাদের সরকারি লোক হিসেবে জানে গ্রামের মানুষ।
হুমায়ুন কবির পল্লব: একসময় এমনটা ছিল না। এর সূচনা হয় মূলত গ্রাম পঞ্চায়েত কমিটির মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য দফাদার ও মহল্লাদার নিয়োগ শুরু হয় ১৭৯৩ সালে। গ্রামের কিছু লোকজনের দান-দক্ষিণার মাধ্যমে তাদের কিছু টাকা-পয়সা দেয়া হতো। অর্থাৎ সবাই ভাগজোক করে কিছু টাকা তুলত। সেই টাকার একটা অংশ থেকে তাদের কিছু টাকা বেতন হিসেবে দেয়া হতো। এর ধারাবাহিকতা এতদিন চলে আসছে। তাদের মর্যাদা নাই। সরকারি বেতনও নাই। কোনো কিছুই নাই।
ঢাকা টাইমস: দফাদার ও মহল্লাদারের কাজ কী?
হুমায়ুন কবির পল্লব: তাদের ১১৯ ধরনের কাজ করতে হয়। যেমন ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের কার্যক্রমে থাকা। নিরাপত্তার বিষয় দেখা। গ্রাম আদালতের যত নোটিশ ও সমন পাঠানোর দায়িত্ব পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। থানা পুলিশকে ইনফরমেশন (তথ্য) দিয়ে সহযোগিতা করা। যেকোনো অপরাধ প্রতিরোধ করার জন্য পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে তারা। অপরাধের তথ্য সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো। কোনো গ্রামে অপরিচিত লোক প্রবেশ করলে সে বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করা। নিয়মিত থানা প্যারেডে অংশ নেওয়া। স্থানীয় যেকোনো নির্বাচনে কাজ করতে হয় তাদের। ইউনিয়নের বিভিন্ন পরীক্ষায় সহযোগিতা করতে হয়। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের কাজ করতে হয়। মোট ১১৯ ধরনের কাজের কথা গ্রামপুলিশের বিধিতে বলা হয়েছে।
হুমায়ুন কবির পল্লব: ধরতে গেলে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা তাদের দায়িত্ব। ঝড়-বৃষ্টি, রাত-বিরাত নাই। যখন কোনো বড় ধরনের সমস্যা হয় তখনই তাদের সেখানে ছুটে যেতে হয়। যদি কোনো দুর্ঘটনায় কোনো লাশ পাওয়া যায়, সেখানে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয় থানা থেকে পুলিশ না যাওয়া পর্যন্ত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ রকম অনেক ঘটনাই তাদের জীবনের সঙ্গী। এটা একটা ভয়াবহ বিষয়।
হুমায়ুন কবির পল্লব: ২০১৮ সাল থেকে তাদের বেতন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। ছেলেমেয়ে, মা-বাবাকে নিয়ে এই অর্থ দিয়ে সংসার চালাতে হয় তাদের। আর্থিক এই দৈন্যের কারণে সামাজিকভাবে তাদের খুবই হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। তাদের ছেলেদের সঙ্গে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। এটা কিন্তু ট্র্যাডিশনালি। অনেকেই বলেন, এই চৌকিদারের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে না। তারা সামাজিকভাবে খুবই অবহেলিত।
হুমায়ুন কবির পল্লব: ইউনিয়ন পরিষদে তিন ধরনের লোক থাকেন। তারা হলেন সচিব, দফাদার ও মহল্লাদার। এই তিনজন হলেন ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব কর্মচারী। একটা ইউনিয়নে সচিব, দফাদার ও মহল্লাদারসহ মোট ১০ জন দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মধ্যে সচিব সরকারি বেতন পান। দফাদার ও চৌকিদাররা বেতনের অর্ধেক পান রাজস্ব বোর্ড থেকে, বাকি অর্ধেক টাকা পান ইউনিয়ন পরিষদের ফান্ড থেকে। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের মতোই তাদের বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও তারা তা পাচ্ছেন না।
হুমায়ুন কবির পল্লব: এটা আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি। আমি ৪৭ হাজার পরিবারের জন্য লড়েছি। আইনগতভাবে সহযোগিতা দিতে পেরেছি। এ ধরনের একটা অর্জন আমার মাধ্যমে হয়েছে, আমি খুবই অভিভূত। আমি তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছি। আমার এই অর্জন গ্রামপুলিশের ৪৭ হাজার পরিবারের জন্য উৎসর্গ করছি।
সবচেয়ে বড় বিষয়, ২০০ বছরের বেশি আগে থেকে এই গ্রামপুলিশ বাহিনীর অস্তিত্ব। ১৭৯৩ সালে তাদের যাত্রা শুরু। ২২৬ বছর ধরে তারা অবহেলিত, বঞ্চিত, শোষিত। সেই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে তারা এ রায়ের মাধ্যমে মুক্ত হয়েছেন। এটা ইতিহাসের একটা অংশ হিসেবে থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এই রায়ের ফলে তাদের জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা পাল্টে যাচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা অন্তত বলতে পারবে যে আমার বাবা সরকারি চাকরি করেন। শুধু তাই না, এতদিন বেতন কিছুই পেত না। যখন অবসরে যাচ্ছেনে তখনো কিছু নাই। এখন ১৯ ও ২০তম গ্রেডে বেতন হচ্ছে তাদের, সারা জীবন বেতন-ভাতা পাবেন তারা। সরকারি পেনশন পাবেন।
মামলার রায়ে মহল্লাদারের জাতীয় বেতন স্কেলের ২০তম গ্রেডে এবং দফাদারের ১৯তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। পাশাপাশি বেতন স্কেল অনুসারে ২০১১ সালের ২ জুন থেকে তাদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
হুমায়ুন কবির পল্লব: আপনাকে ও ঢাকা টাইমসকেও ধন্যবাদ।
১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আদালত বলেছেন, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ মুজিববর্ষ শুরু হওয়ার আগেই নির্দেশ অনুসারে গ্রামপুলিশের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে আদালতে হলফনামা দিতে হবে। স্থানীয় সরকার সচিবের প্রতি এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, গ্রামপুলিশ সদষ্যদের অবসর ভাতা দেয়ার ক্ষেত্রে নিজ নিজ যোগদানের তারিখ থেকে এই ভাতা গণনা শুরু করতে হবে।
২০০৮ সালে গ্রামপুলিশের সদস্যদের জাতীয় বেতন স্কেলের চতুর্থ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে লাল মিয়াসহ ৩৫৫ জন গ্রামপুলিশ সদস্য হাইকোর্টে একটি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এতে ২০০৮ সালের সিদ্ধান্ত অনুসারে গ্রামপুলিশ সদস্যদের চতুর্থ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করে আদালত।
রায়ের বিষয়টি জানিয়ে আইনজীবী হুমায়ূন কবির সাংবাদিকদের বলেন, ৩৫৫ জন রিট করলেও সারা দেশে ৪৭ হাজার গ্রামপুলিশ সদস্য রয়েছেন। রিট আবেদনকারীসহ সবাই এসব সুবিধা পাবেন। ১৯তম গ্রেডে দফাদাররা পাবেন সর্বসাকুল্যে ২০ হাজার ৫৭০ টাকা। আর ২০তম গ্রেডে মহল্লাদারদের সব মিলে বেতন হবে ২০ হাজার ১০ টাকা।