প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার প্রতারণা করছে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে গাম্বিয়ার আইনজীবী পল রাইখলার বলেছেন। তারা আদালতে এ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে তাতেও প্রতারণা রয়েছে জানিয়ে রাইখলার বলেন, মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে, খুব সামান্য সংখ্যকই ফিরেছে। মিয়ানমারের আইনজীবী মিস ওকোয়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং চীন, জাপান ও ভারতের সহায়তার বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, সহায়ক দেশগুলো প্রত্যাবাসন চায়। কিন্তু, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির পুরোপুরি দায়িত্ব মিয়ানমারের। মিয়ানমার সেটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। গাম্বিয়ার আইনজীবিরা আদালতের উদ্দেশে বলেন, বিজ্ঞ আদালত নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, সুচি আদালতে দেয়া বক্তব্যে রোহিঙ্গা বিশেষণটি ব্যবহার করেননি। শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আরসা গোষ্ঠীর কথা বলার সময় ছাড়া তিনি তাদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

পল রাইখলার মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সাবাসের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, সাবাস গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন। সেই সাতটি নির্দেশকগুলোর কথা গাম্বিয়ার আবেদনে রয়েছে এবং মিয়ানমার সেগুলো অস্বীকার করেনি। শুনানির আজকের চূড়ান্ত পর্বে দেয়া বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী আববুবকর তামবাদু বলেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গাম্বিয়া ওআইসি’র কাছে সাহায্য চেয়েছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে গাম্বিয়া একা এই আবেদন করেছে। গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের রক্ষক হিসেবে আদালতের কাছে জরুরি অন্তবর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনার দাবি জানাচ্ছে। তামবাদু বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। গাম্বিয়া প্রতিবেশী না হতে পারে, কিন্তু গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বন্ধ এবং তা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।

গাম্বিয়ার আইনজীবী অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস যুক্তিতর্ক তুলে ধরে বলেন, অন্তর্বর্তী আদেশ, পরিস্থিতির জন্য সহায়ক হবে না, মিয়ানমারের এমন দাবির জবাব হচ্ছে, আমরা সে কারণেই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছি। বসনিয়ায় আদেশ দেয়ার পরও সেব্রেনিৎসায় যে গণহত্যা হয়েছিল সেই দৃষ্টান্ত দিয়েই আমরা বলেছি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা কেন প্রয়োজন এবং তার বাস্তবায়নের সময়  বেঁধে দেয়া জরুরি। অধ্যাপক সাবাস তার ২০১৩ সালের সাক্ষাৎকারে গণহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেছিলেন সেগুলো যদি আদালত তার নির্দেশে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাতে আমরা আপত্তি করব না।

অধ্যাপক সাবাস শিক্ষাবিদ হিসেবে ২০১৩ সালে গণহত্যা কাকে বলে তার ব্যাখ্যায় আল-জাজিরাকে কী বলেছিলেন তা উল্লেখ করে অধ্যাপক স্যান্ডস বলেন, তিনি যে মত বদলাতে পারেন না সেকথা আমি বলব না। উল্লেখ্য মিয়ানমারের আইনজীবী হিসাবে অধ্যাপক সাবাস দাবি করেছিলেন, মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু গণহত্যা নয়। গণহত্যার উদ্দেশ্য সেখানে অনুপস্থিত।

অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস আরও বলেন, গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সাবাস একটি নতুন আইনগত মান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যেটি পরীক্ষিত নয়। কিছু কিছু কার্যক্রম গণহত্যার নির্দেশিকার ধারণা   তৈরি করলেও সব কার্যক্রম গণহত্যার ধারণা প্রমাণ করে না এমন দাবি ঠিক নয়। তিনি বলেন, ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করছে কিনা সে প্রশ্ন তোলার অধিকার গাম্বিয়ার অবশ্যই রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি অতীতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সনদের অংশীদার হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে।

গাম্বিয়ার আরেক আইনজীবী পিয়েঁর দ্য আর্জেন বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকার বলেছেন যে, কোনো অপরাধ যদি ঘটেও থাকে তাহলেও গাম্বিয়ার সে বিষয়ে মামলা করার অধিকার নেই। মামলা কূটনৈতিক ব্যবস্থায় তার আপত্তির কথা জানাতে পারে, কিন্তু আদালতে আসতে পারে না। স্টকারের এসব বক্তব্য সঠিক নয়। গাম্বিয়া সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদনের অধিকার রাখে। গাম্বিয়া ওআইসি মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকারের দাবি বিভ্রান্তিকর। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ওআইসি’র নয়, গাম্বিয়ার। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে গণহত্যার কথা বলেননি বলে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে ওআইসি’র সিদ্ধান্তের পরই গাম্বিয়া মামলা করেছে- কথাটি ঠিক নয়। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে বক্তব্য  দেয়ার পর জাতিসংঘ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতেই গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে গাম্বিয়া আদালতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি আরো বলেন, গাম্বিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মামলা করেছে। গাম্বিয়া ওআইসি’র প্রক্সি বা প্রতিভূ হিসেবে মামলা করেনি। গাম্বিয়া ওআইসি’র সাহায্য চাইতেই পারে। অন্যান্যদেরও সাহায্য চাইতে পারে। সুতরাং, গাম্বিয়া ওআইসি’র সহায়তা  নেয়ায় বলা যাবে না যে, ওআইসি এই মামলার আবেদনকারী।

রাখাইনে গণহত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা
আইনজীবী পল রাইখলার রাখাইনে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতার মর্মস্পশী বর্ণনা তুলে ধরেন। কীভাবে নারী, শিশুদের হত্যা করেছে সেনাবাহিনী, ধর্ষণ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে তার বর্ণনা দেন তিনি। এ সময় তিনি মিয়ানমারের যুক্তি খণ্ডন করেন। বলেন, মিয়ানমার দাবি করেছে রাখাইনে ছিল তাদের সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান। সন্ত্রাসী বা আরসামুক্ত করতে তারা অভিযান চালিয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, তাহলে রোহিঙ্গা শিশুরা কি সন্ত্রাসী? নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারী, মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। শত শত গ্রামে হাজার হাজার বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে অন্তঃসত্ত্বাদের ওপর। রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে এ কথা প্রমাণ করতে তিনি রাখাইনে সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। বলেন, ২০১৭ সালে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরুর দুই সপ্তাহ আগে রাখাইনে সেনা মোতায়েন করা হয়। তখন বলা হয়, বাঙালি সমস্যার সমাধান করা হবে। এ সময় ডিসপ্লেতে ওই সেনা মোতায়েনের ছবি দেখানো হয়।

আইনজীবী পল রাইখলা বলেন, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘাতকে গণহত্যার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যায় না। ওই অভিযানে প্রতিজন মানুষকে টার্গেট করা হয়েছিল। নারী, শিশু, পুরুষ কেউ রক্ষা পায়নি। মিয়ানমার গণকবরের কথা অস্বীকার করেছে। তিনি এ যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, কমপক্ষে ৫টি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়া, তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে জাতিসংঘসহ অন্যদের দেয়া রিপোর্ট উদ্ধৃত করেন তিনি। বলেন, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, তাদের মুক্তভাবে চলাফেরার বিষয়ে নিশ্চয়তা মেলেনি এখনও এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলছে।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031