‘চীনা বুদ্ধি’র আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের একটি অংশ । চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের উন্নয়ন প্রকল্পে নানা কাজ করলেও তারা এদেশে প্রবেশ করছে ‘নাবিক’ পরিচয়ে। সী ইমিগ্রেশনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এবং কর্মচারীকে ম্যানেজ করে এরা দেশে প্রবেশ এবং দিনের পর দিন কাজ করে ফিরে গেলেও শুল্ক পরিশোধ করে না। নিয়মিত বিরতিতে ছুটি কাটিয়ে আবারো এরা এদেশে এসে কাজে যোগ দিচ্ছে। এভাবে গোঁজামিল দিয়ে মাসের পর মাস চাকরি করছে হাজার হাজার চীনের নাগরিক। বেতন ভাতার উপর ত্রিশ শতাংশ শুল্ক পরিশোধের আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক টাকাও ট্যাক্স পরিশোধ করছে না তারা। ছোট্ট একটি বার্জের নামে আড়াইশ’ নাবিকের চট্টগ্রামে আসার ঘটনা অনুসন্ধানে সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থা এসব তথ্য উদঘাটন করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, যে কোন বিদেশি নাগরিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত শুল্কনীতি অনুযায়ী ওই বিদেশি নাগরিকের আয়ের উপর আয়কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একজন বিদেশি নাগরিক টানা ১৮২ দিন এদেশে থাকলে তাকে ‘আবাসিক প্রবাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের নাগরিকদের স্ল্যাবে আয়কর প্রদান করতে হয়। যদি কোন বিদেশি নাগরিক টানা ১৮২ দিনের কম অবস্থান করে সেক্ষেত্রে তার আয়ের ৩০ শতাংশ আয়কর প্রদান করতে হয়। একজন নাগরিক যদি টানা ১৮১ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করে চাকরি বা ব্যবসার মাধ্যমে এক লাখ টাকা আয় করেন তবে আইনানুযায়ী তাকে ৩০ হাজার টাকা ট্যাক্স পরিশোধ করেই এদেশ থেকে যেতে হবে। এই টাকা শুল্ক পরিশোধ করে আয়কর বিভাগ থেকে ক্লিয়ারেন্স না নিলে ওই বিদেশিকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়ার বিধান রয়েছে।
কিন্তু এসব নিয়ম কানুন এবং শুল্ক জাহাজের নাবিকদের জন্য ছাড় রয়েছে। যে কোন দেশের নাবিক এদেশে জাহাজে কাজ করতে আসলে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে দেশে প্রবেশ করলেও তাকে পুনরায় সী ইমিগ্রেশন করাতে হয়। আবার ফেরার সময়ও সী ইমিগ্রেশন থেকে পার হয়ে বিমানবন্দর হয়ে যেতে হয়। আবার সরাসরি জাহাজ নিয়ে চলে গেলেও তাকে সী ইমিগ্রেশন থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে যেতে হয়। নাবিকদের সাময়িক অবস্থানের এই আয়ের উপর কোন ধরনের শুল্ক আদায় করা হয় না।
এই সুযোগটি গ্রহন করে চীনা নাগরিকদের একটি অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করলেও এদেশে প্রবেশ করছে নাবিক পরিচয় দিয়ে। চট্টগ্রাম, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পায়রাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অধিকাংশই চীনের কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। চীনা ঠিকাদারদের পরিচালিত এসব কর্মকাণ্ডে নিয়োগ দেয়া হয়েছে হাজার হাজার চীনা নাগরিক। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নানা ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ লাখ চীনা নাগরিক কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের ইকুইপমেন্ট পরিবহনের জন্য অনেকগুলো বার্জ এবং ওপেন হ্যাজ লাইটারেজ জাহাজ এসেছে বাংলাদেশে। দেশের অভ্যন্তরীন নৌরুটে এসব জাহাজ বিভিন্ন প্রকল্পের পণ্য পরিবহন করছে। তবে এসব জাহাজের বেশ কয়েকটি কোন ধরনের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে ভাড়ায় ব্যবসায়ীদের পণ্যও পরিবহন করছে। আর এসব বার্জের নামে দেশে শত শত চীনা নাগরিক প্রবেশ করছে। স্বাভাবিকভাবে একটি বার্জে সর্বোচ্চ ২০/২১ জন নাবিক থাকে। কিন্তু একটি বার্জের নামে আড়াইশ’ নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরের সী ইমিগ্রেশন পার হয়েছে। নানা ছলচাতুরী এবং মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের লোকজন নাবিক পরিচয়ে সী ইমিগ্রেশন পার হয়। প্রতিজন কথিত নাবিকের ইমিগ্রেশনের জন্য মাথাপিছু ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন বার্জের নামে আসা চীনা নাগরিকেরা এভাবে নিজেদেরকে নাবিক পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করলেও মুলত উন্নয়ন প্রকল্পের অন্যান্য কাজ করে। শুল্ক ফাঁকি দিতেই চীনা নাগরিকদের এই ‘চীনা বুদ্ধি’ নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের কয়েকটি শিপিং এজেন্সির বিরুদ্ধেও যোগসাজসের অভিযোগ উঠেছে। চীনা নাগরিকদের নাবিক হিসেবেই তারাই এদেশে আনার যাবতীয় ব্যবস্থা করে। চীনা নাগরিকেরা নিজ দেশেই নানা পন্থায় সীম্যান বুক তৈরি করে বলেও সূত্রটি উল্লেখ করেছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সী ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জহিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে যেসব সীম্যান আসেন আমরা শুধু তাদেরই ইমিগ্রেশন করি। সীম্যান নয় এমন কাউকে ইমিগ্রেশন করার কোন সুযোগ আমাদের নেই। সীম্যান না হলে একজন চীনা নাগরিক বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশই করতে পারবেন না। স্থানীয় এজেন্টদের অনুমোদনসহ সীম্যান বুক থাকলে তাকে ইমিগ্রেশন না করার কোন সুযোগতো আমাদের নেই। এজেন্টের চাহিদা বন্দরের কন্ট্রোলসহ বিভিন্ন সংস্থার যাছাই বাছাইয়ের পরই কেবল সীম্যান আনার অনুমোদন দেয়া হয়। যারা অনুমোদন নিয়ে আসেন তাদের আমরা ইমিগ্রেশন করিয়ে দিই। এক্ষেত্রে কোন ধরনের অনিয়ম বা টাকা পয়সার লেনদেনের কথা তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। একটি বার্জে কতজন নাবিক আসতে পারে জানতে চাইলে ওসি সী ইমিগ্রেশন মোহাম্মদ জহির বলেন, একটি বার্জ থেকে নানা কাজ হয়। তাদের চাহিদানুযায়ী সীম্যান আসে।
তিনি বলেন, অনেক চীনা নাগরিক বিমানবন্দরে ৫১ ডলার সরকারি ফি জমা দিয়ে ভিসা নিয়ে এদেশে প্রবেশ করতে পারেন। তারা বিমানবন্দর থেকে নিজেদের মতো করে নিজেদের কাজে যান। এরা সী কাস্টমসে আসে না। এভাবে আসা একজন চীনের নাগরিক এক দুই মাস থাকতে পারেন।
বিষয়টি নিয়ে নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনার কথা তিনি জানেন না। খোঁজ খবর নিতে হবে। তবে বিদেশি যেসব বার্জ চট্টগ্রামে রয়েছে তাদেরকে বিভিন্ন শর্তে সাময়িকভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে বার্জগুলোকে ত্রিশ দিনের বেশি থাকতে হলে পঞ্চাশ শতাংশ বাংলাদেশী নাবিক নিয়োগ দিতে হবে। যেহেতু আমাদের লোকবলের অভাব সেহেতু এরা এই শর্ত পালন করছে কিনা তা পরখ করা হয়ে উঠেনা। বিষয়টির সাথে কোস্টগার্ডকে যুক্ত করার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছি। যারা বিভিন্ন বার্জে পরীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিত করবে। তবে নাবিক পরিচয়ে আসা চীনা নাগরিকদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করার জড়িত হওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না বলেও জানান।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, চীনের বহু নাগরিক সীম্যান পরিচয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তারা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ৪/৫ মাস কাজ করে স্বদেশে ফিরে যায়। কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আবারো আসে। এভাবে বহু শ্রমিকই নিজেদের সী ম্যান পরিচয় দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। কয়েক হাজার চীনা নাগরিকের এভাবে শুল্ক ফাঁকি বেশ বড় একটি অংকে দাঁড়াচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।