চট্টগ্রামের কপালে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাণিজ্যিক রাজধানীর তকমা রয়েছে । রাষ্ট্রায়ত্ত্ব জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) প্রধান কার্যালয়টি সবেধন নীলমণি হিসেবে চট্টগ্রামকে কিছুটা আলোকিত করেছে। কিন্তু বর্তমানে সে আলো ফিকে হয়ে এসেছে। চট্টগ্রামে বিপিসি’র প্রধান কার্যালয় এখন শুধু নামেই।
অভিযোগ রয়েছে, বিপিসির চেয়ারম্যান মাসে একবার চট্টগ্রামে আসেন। থাকেন এক কিংবা দুইদিন। তিন পরিচালকের দুইজন বেশিরভাগই থাকেন ঢাকায়। বিপিসির জয়পাহাড়ের বাংলোগুলোর একটিতে থাকেন ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মকর্তা। একটি বাংলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানানো হলেও অন্য একটিতে বসবাস সুইপার ও সিকিউরিটি গার্ডের। বিপিসির সিনিয়র অফিসিয়ালরা ঢাকামুখী হওয়ার কারণে অনেক মিটিং ঢাকায় গিয়ে করতে হয় বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। এতে একদিকে সরকারি রাজস্বের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে চট্টগ্রামের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতিও পড়ছে সমালোচনার মুখে।
জানা গেছে, চেয়ারম্যানসহ বিপিসির সিনিয়র কর্মকর্তাদের ঢাকামুখীতার কারণে ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ‘বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের হেড অফিস চট্টগ্রামে অবস্থান প্রসঙ্গে’ নির্দেশনা সম্বলিত একটি পত্র দেওয়া হয় চেয়ারম্যানকে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ওই সময়ের উপ-সচিব সৈয়দা নওয়ারা জাহান স্বাক্ষরিত পত্রে, ‘বিপিসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ বিপিসির হেড অফিস চট্টগ্রামে না থেকে প্রায়শ ঢাকা অবস্থান করছেন। উক্ত কর্মকর্তাগণের অনুপস্থিতির কারণে বিপিসির দাপ্তরিক কাজকর্ম সঠিক সময়ে সম্পাদক করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির ফলে উক্ত অফিসে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে বিপিসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত/অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় আসার প্রয়োজন হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ এবং বিপিসির কোন মিটিং করার প্রয়োজন হলে তা মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে মিটিং এর সময় নির্ধারণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল’ মর্মে উল্লেখ করা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা
গেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। চেয়ারম্যান ও অন্য পরিচালকরা ঢাকামুখী হওয়ার কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিনিয়র কর্মকর্তারাও ঢাকামুখী হয়ে পড়ছেন। কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সপ্তাহের অর্ধেক সময় ঢাকায় অফিস করেন। আবার কোম্পানির দাপ্তরিক অনেক মিটিংও ঢাকায় করতে হয়। বিশেষ করে মাসিক সাধারণ সভা ও বোর্ড সভার বেশিরভাগই ঢাকায় করতে হয় বিপণন কোম্পানিগুলোকে। সর্বশেষ গত ২৫ নভেম্বর যমুনা অয়েল কোম্পানির বোর্ড সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিপিসির চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান বিগত তিন মাসে চার বার চট্টগ্রামে এসেছেন। তন্মধ্যে ২৬ অক্টোবর থেকে পরবর্তী এক বছর মেয়াদে বিপিসির চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার তিনি দুইবার চট্টগ্রামে এসেছেন। সর্বশেষ এসেছেন ২৬ নভেম্বর। ওইদিন সকালে এসে বিকেলেই তিনি ঢাকায় চলে যান। এর আগে নতুন করে পদায়নের পর ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রামে অফিস করেন। ২০ নভেম্বর চট্টগ্রামে অফিস করে ওইদিন বিকেলেই ঢাকা চলে যান। আগে ১৯ ও ২০ অক্টোবর দুইদিন তিনি চট্টগ্রামে অফিস করেন। এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে এলেও ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে অফিস করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিপিসির চেয়ারম্যান ঢাকায় থাকার কারণে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকতে হয়। প্রত্যেকটি বিপণন কোম্পানির বোর্ডসভায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে কোম্পানিগুলোর ব্যয়ও বেড়েছে। কোম্পানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মানেই শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।’
জানা যায়, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত পেট্রোবাংলার একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল বিপিসি। ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি পৃথক অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিপিসি গঠিত হয়। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব জ্বালানী তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয় এবং প্রধান ডিপো চট্টগ্রামে হওয়াতে এবং সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির কারণে ১৯৮৯ সালে বিপিসির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। তখনকার বিপিসির চেয়ারম্যান ফজলুল হক চট্টগ্রামে অবস্থান করতেন। তাঁরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী চেয়ারম্যান সরকারের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেনও মাসের বেশিরভাগ সময় চট্টগ্রামেই অফিস করতেন। অপ্রয়োজনে তিনি ঢাকায় যেতেন না। ধারাবাহিকভাবে বিপিসির অনেক চেয়ারম্যান জয়পাহাড়ের ১নং বাংলোতে থাকতেন। চেয়ারম্যানের ওই বাংলোকে (১নং বাংলো) বর্তমানে ভিআইপি রেস্ট হাউজ বানিয়েছে বিপিসি। বর্তমানে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) মো. সরওয়ার আলম, পরিচালক (বিপণন) সৈয়দ মেহদী হাসানও থাকেন ঢাকায়। তারা শুধুমাত্র মিটিং করার জন্যই চট্টগ্রামে আসেন। পরিচালক (অর্থ) মো. শহীদুল আলম ও বিপিসির সচিব কাজী মোহাম্মদ হাসান থাকেন চট্টগ্রামে। তন্মধ্যে সচিব থাকেন জয়পাহাড়ের বিপিসির সরকারি বাংলোতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিপিসির চেয়ারম্যান চট্টগ্রামে অবস্থান করলে থাকেন জয়পাহাড়ের ১নং বাংলোর ভিআইপি রেস্ট হাউজে। ৮টি বাংলোর ২নং বাংলোতে আগে বেশ কয়েকজন পরিচালক বসবাস করলেও অতিসম্প্রতি এটিকে ট্রেনিং সেন্টার বানানো হয়েছে। ৩নং বাংলোতে থাকেন বিপিসির সচিব। ৪নং বাংলোতে থাকতেন বিপিসির আবাসিক চিকিৎসক। তিনি কর্মকালীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর থেকে ওই বাংলোতে সুইপার ও সিকিউরিটি গার্ডরা থাকছেন। ৫নং বাংলোতে থাকেন যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দীন আনচারী। তিনি বিপিসির মহাব্যবস্থাপক থাকাকালীন থেকে ওই বাংলোতেই থাকতেন। ৬নং বাংলোতে থাকেন বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (এমআইএস) আবুল কালাম আজাদ, ৭নং বাংলোতে মহাব্যবস্থাপক (নিরীক্ষা) ইউসুফ হোসেন ভুঁইয়া এবং ৮নং বাংলোতে থাকেন ব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আপেল মামুন।
বাংলোগুলোর তত্ত্বাবধানকারী বিপিসির ম্যানেজার (সাধারণ কর্মশাখা) মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পর কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে পরে বিপিসির উপ-ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) মো. আল আমীন ফোন করে জানান মিজানুর রহমান প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে অনিচ্ছুক। তবে জয়পাহাড়ের ভিআইপি রেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার ওমর ফারুক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান স্যার চট্টগ্রামে আসলে থাকেন। তিনি (চেয়ারম্যান) মাসে দুই-তিন বার আসেন। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও চট্টগ্রামে আসলে রেস্ট হাউজে উঠেন।’
এ বিষয়ে বিপিসির সচিব কাজী মোহাম্মদ হাসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমি জয়পাহাড় বাংলোতে থাকি। চেয়ারম্যান স্যারসহ অন্য সিনিয়ররাও চট্টগ্রামে অফিস করেন। মন্ত্রণালয়ে মিটিং থাকার কারণেই বেশিরভাগ সময় তাদের ঢাকায় থাকতে হয়। একইভাবে মিটিংয়ের কারণে আমাকেও সপ্তাহে এক-দুইদিন ঢাকা যেতে হয়।’
এ ব্যাপারে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান শনিবার রাতে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের মিটিং, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে মিটিংসহ বিদেশীদের সাথে নানান সময়ে মিটিং করতেই ঢাকায় বেশিরভাগ সময় অফিস করতে হয়। তারপরেও এখন সবগুলো কাজ ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে করা হয়। যে কারণে প্রধান কার্যালয়ের দাপ্তারিক কার্যক্রমে কোন ব্যঘাত ঘটে না।’ তিনি বলেন, ‘আমার দুই পরিচালক সবসময় চট্টগ্রামে থাকেন। শুধু পরিচালক মার্কেটিং ঢাকায় থাকেন।’

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031