জেরবার সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের অস্থিরতায়। এমনিতে বাজারে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। সঙ্গে যোগ হয়েছে পিয়াজের অস্বাভাবিক দাম। কোন কারণ ছাড়াই বেড়েছে চালের দাম। লবণ নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল মানুষের মাঝে। গুজব ছড়িয়ে একটি চক্র হাতিয়ে নিয়েছে অর্থ। পণ্যবাহী যানের ধর্মঘটের কারণে গত দুই দিন ধরে প্রভাব পড়েছে কাঁচাপণ্যের বাজারে। ১০ থেকে ২০ টাকা কেজিতে দাম বেড়ে গেছে বিভিন্ন সবজির।
এমনই নানা অজুহাতে সময়ে সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ ক্রেতারা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের এমন পরিস্থিতি মানুষের সার্বিক ক্রয় ক্ষমতার জন্য অস্বস্থিকর। এমন পরিস্থিতি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে বাজার তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ তাদের। কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, বাজারের অস্থিরতার মূল কারণ পর্যাপ্ত তদারকির অভাব। তদারকি বাড়ালে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যবস্থাপনায় কোনো সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়নি। বরং পিয়াজ-চালের দাম বেড়েছে। কিন্তু যখন দাম বেড়েছে, তখন প্রান্তিক কৃষকের কাছে ধান নেই। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধির সুবিধাভোগী মূলত মিলমালিক, আড়তদার ও মজুতদাররা। ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে দেশের বাজার। সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার থাকলে অন্তত ব্যবসায়ীরা যখন-তখন পণ্যের দাম বাড়াতে পারতো না।
জানা গেছে, বাজার মনিটরিংয়ে বর্তমানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, ট্যারিফ কমিশন ও মূল্য প্রতিযোগিতা কমিশন কাজ করছে। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলও কাজ করছে। এতগুলো সংস্থা কাজ করার পরও কাজের কাজ তেমন কিছু হয় না। ভোক্তাকেই এর খেসারত দিতে হচ্ছে।
বাজার
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে বেশ কয়েকটির
দাম আকাশ ছোঁয়া। এর মধ্যে ৩০ টাকা কেজির পিয়াজই ২৬০ টাকায় পৌঁছে। যদিও গত
কয়েক দিনে দাম কমে এখন তা ২০০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। দেশব্যাপী পিয়াজ নিয়ে
হইচইয়ের মধ্যেই বেড়ে যায় চাল, তেল, লবণ, সবজিসহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম।
চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা। এই দাম বাড়ার পেছনে যৌক্তিক কোন
কারণও নেই।
ভোজ্যতেলে দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। বেশ কয়েকটি সবজির দাম
এখন ১০০ টাকার ঘরে। ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি শসা। টমেটো
বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি দরে। এরই মধ্যে গুজবের হুজুগে ৩৫ টাকার লবণ
বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছে। বাজারে সঙ্কট না থাকলেও গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি
করে একটি মহল।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, তিন মাস আগেও প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ভারতীয় পিয়াজ ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। সেপ্টেম্বরের শেষে ভারত পিয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর তাতেই ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কারসাজি করে পিয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয়। এর পর ৫০, ৬০, ৮০, ১০০, ১২০, ১৬০, ২০০, ২৫০ এবং সর্বশেষ ২৬০ টাকায় ওঠে পিয়াজের দর। আর চক্রটি হাতিয়ে নেয় শত শত কোটি টাকা।
শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার কার্গো বিমানে পিয়াজ আমদানির ঘোষণা দিলে থমকে দাঁড়ায় বাজার। সর্বশেষ বুধবার পাইকারি বাজারে পিয়াজের কেজি ১৬০ টাকায় নেমে আসে। পিয়াজ নিয়ে আলোচনার মধ্যে চালের দামও বেড়েছে। রাজধানীর মৌলভীবাজার পাইকারি মার্কেটে প্রতি কেজি ভালো মানের মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৫৯ থেকে ৬০ টাকায়। খুচরা বাজারে এসে একই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে খুচরা বাজারেই এ দাম ছিল ৫৮ থেকে ৫৯ টাকা। কয়েক দিন আগে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে মোটা চালের কেজি প্রতি দর ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা, যা এখন বিক্রি হয় ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা কেজি দরে। মাঝারি মানের বিআর-২৮ জাতের চালের দাম কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। অথচ আড়তদার, মিল মালিক কিংবা খুচরা বিক্রেতা-সবাই একবাক্যে বলছেন এ সময়ে এভাবে চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার নিজেও বলেছেন, দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে এবং সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। কাওরান বাজারে জনপ্রিয় রাইছ এজেন্সীর বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, সব চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ১ টাকা বেড়েছে। অবরোধের কারণে চালের বাজারে প্রভাব পড়ে নাই।
রাজধানীর কাওরান বাজার, মোহাম্মদপুরের টাউনহল মার্কেট, শিয়া মসজিদ সংলগ্ন কাচা বাজার ও পলাশী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, একদিনের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সব সবজির। কাওরান বাজারে পণ্যের মূল্য কিছুটা কম বৃদ্ধি পেলেও অবরোধকে ইস্যু করে অধিক মূল্য রাখছেন বিক্রেতারা। ২দিন আগে বেগুনের কেজি ছিলো ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। একদিন আগের আগের মূল্য থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ টাকা। শশা বুধবার প্রকার ভেদে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হলেও একদিন পর বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১২০টাকায়। একটি বড় আকারের ফুলকপি রাখা হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ঢাকার খুচরা বাজারে পাকা টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।
গত এক সপ্তাহে ভোজ্যতেলের দামও বেড়েছে লিটারে ৪ থেকে ৫ টাকা। আদার দাম কয়েক মাস ধরেই বেশি। আমদানি করা আদা ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা এবং দেশি নতুন আদা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে বয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে বাজারে যে মুরগি বিক্রি হয় ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে গতকাল সেগুলো বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। খুচরা বাজারে পাকিস্তানি কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা কেজিতে। আর লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। বাজারভেদে গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকা এবং খাসির গোশত বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজি দরে। বাজারে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৮ টাকায়।
রাজধানীর খুচরা বাজারে কয়েক মাস ধরেই এমন
চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ ছাড়া সব ধরনের মাছ। খুচরা বাজারে এক কেজি থেকে ১
কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে। ৮০০
গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি।
বাজার ও মানভেদে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছ বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৮০
টাকা। রুই ও কাতল মাছ বিক্রি হয় ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে।
বিশেষজ্ঞদের
মতে, অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে আর
সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো। বর্তমানে বাজারে যেসব
পণ্যের দাম বেড়েছে, পিয়াজ ছাড়া কোনোটির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। ভ্রাম্যমাণ
আদালতের অভিযানে গুটিকয়েক ছোট ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও বড় মজুতদারেরা বরাবরের
মতো রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।