ডাইনোসর যুগেরও আগের, ৪৫ কোটি বছর পুরনো প্রাণী বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গোপসাগরের একমাত্র লিভিং ফসিল বা জীবন্ত জীবাশ্ম। সেই রাজকাঁকড়া বা হর্সশো ক্র্যাব দেশের সমুদ্র উপকূল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। আশ্চর্য ঔষধি গুণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত দামী এই প্রাণীটির রক্ত ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লোভে গোপনে পাচার করে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কিছু শক্তিশালী সিন্ডিকেট এটির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
চিকিৎসা শাস্ত্রে রাজকাঁকড়ার নীল রক্ত জাদুকরী ক্ষমতা সম্পন্ন। মানুষের শরীরের রক্তক্ষরণ দ্রুত বন্ধ করতে এবং মেডিকেল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে কাঁকড়ার নীল রক্ত অতুলনীয়। এছাড়া এর শরীরের পেছনে থাকা ছোট্ট লেজটি দিয়ে তৈরি করা হয় ক্যানসারের ওষুধ। এখন চিকিৎসা শাস্ত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা একেকটি রাজকাঁকড়ার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫ লাখ টাকা। প্রতি গ্যালন রক্তের দাম ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫০ লাখ টাকা বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাময়িকী ও গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে জানান কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল হক। কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই প্রাণীটি ‘দিয় কিঁয়ারা’ বা দৈত্য কাঁকড়া নামে পরিচিত। দুই যুগ আগে কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলের জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে রাজকাঁকড়া দেখা যেত। কিন্তু বিস্তীর্ণ উপকূল থেকে এ প্রাণীটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে এখনো বিভিন্ন দ্বীপ ও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদঘেরা কাদা-বালুকাময় অঞ্চলে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের পর্যবেক্ষণেও বাংলাদেশে প্রাণীটির অবস্থান লাল তালিকায়।
সমুদ্র বিজ্ঞানী আশরাফুল হক বলেন, ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরেও প্রাণীটিকে বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে দেখা যেত। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী সীতাকুণ্ডের কুমিরা উপকূলে প্রাণীটি দেখেছেন। কিন্তু দামী এই প্রাণীটি সাম্প্রতিককালে প্রকৃতি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক ও উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজার শহরের বিমানবন্দর সড়কের বাসিন্দা জুলফিকার আলী স্থানীয় জেলেদের বরাত দিয়ে বলেন, ২০/২৫ বছর আগেও শহরের বাঁকখালী নদীর মগচিতা পাড়া নামক স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে দৈত্য কাঁকড়া দেখা যেত। ১০ বছর আগেও শহরের উত্তর নুনিয়াছড়ায় বাঁকখালী নদীর মোহনায় দেখা যেত। চার বছর আগে সোনাদিয়ায় দেখা গেছে। কিন্তু এখন বিলুপ্তির পথে।
একই কথা জানান সীতাকুণ্ডের কুমিরার উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাইয়ুম। তিনি জানান, সীতাকুণ্ড এলাকার সমুদ্র উপকূলের নদী ও খালের মোহনায় একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে রাজকাঁকড়া দেখা যেত। অনেকদিন ধরে আর দেখা যাচ্ছে না।
বাঁশখালীর গণ্ডামারা এলাকার আবুল হোসেন জানান, বাঁশখালী সমুদ্র উপকূলের নদী বা খালের মোহনায়ও একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে রাজকাঁকড়া দেখা যেত। বিশেষ করে শীতকালে।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলে রাজকাঁকড়া কমে যাওয়ায় অতিথি পাখির আগমনের হারও কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন সমুদ্র বিজ্ঞানী ও কক্সবাজারের সাবেক জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. ম কবীর আহমদ। তিনি বলেন, শীতকালে অতিথি পাখি হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসে। এসময় অতিথি পাখিরা এই কাঁকড়ার ডিম খেয়ে দুর্বল শরীরে শক্তি সঞ্চার করে। তিনি জানান, একটি নারী রাজকাঁকড়া বছরে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত ডিম দেয়। এর মধ্যে কয়েক হাজার বেঁচে থাকে।
তবে দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলে রাজকাঁকড়ার প্রায় আবাসস্থল হারিয়ে গেলেও দেড় বছর আগে শহরের নাজিরারটেকের ওপারে মহেশখালীর প্যারাবনে ৫/৬টি রাজকাঁকড়ার একটি দলকে দেখতে পেয়েছেন বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. শেখ আফতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ নামে পরিচিত বঙ্গোপসাগরের এই আদি প্রাণীটি পৃথিবীর অত্যন্ত প্রাচীন দল। তাদের জীবাশ্মের আত্মীয়রা অর্ডোভিশিয়ান পিরিয়ড (৪৮৫.৪ মিলিয়ন থেকে ৪৪৩.৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে) হিসাবে স্বীকৃত। অর্থাৎ জুরাসিক পিরিয়ডের (২০১.৩ মিলিয়ন থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর আগের) পূর্ববর্তী যুগের এই প্রাণীটি চরম প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকা আদি প্রাণী। অথচ এখন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে ঔষধি গুণের কথা প্রচার হওয়ার পর প্রাণীটি পড়েছে ঝুঁকির মুখে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে একটি প্রাপ্তবয়স্ক হর্সশো ক্র্যাব থেকে ৪০০ মিলিলিটার এবং অল্প বয়স্ক থেকে ৫০ মিলি রক্ত সংগ্রহ করার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ হর্সশো ক্র্যাব মারা যায়। হর্সশো ক্র্যাবকে টিকিয়ে রাখার জন্য উন্নত বিশ্বে শরীর থেকে ১৫% থেকে ৩০% ভাগ রক্ত টেনে নেয়া হয়। অনেক দেশে প্রায় পুরো রক্ত টেনে নিয়ে প্রাণীটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়।
সমুদ্র বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. শাহাদৎ হোসাইন জানান, হর্সশো ক্র্যাব চিকিৎসা ক্ষেত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থান। এর অনন্য নীল রং অল্প পরিমাণে ব্যাকটেরিয়াজনিত দূষণও সনাক্ত করতে সক্ষম। এরা রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন বহন করতে হিমোসায়ানিন ব্যবহার করে। হিমোসায়ানিনে থাকা কপার বা তামার কারণেই তাদের রক্ত নীল। চিকিৎসা অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোটক্সিন সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হয় এই নীল রক্ত।
রাজকাঁকড়া নিয়ে বাংলাদেশেও গবেষণা হওয়া উচিত বলে মনে করেন কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী। এই প্রাণীটি কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিল তা মানবজাতির জন্য শিক্ষনীয় বলে মনে করেন তিনি।
সাম্প্রতিককালে সমুদ্র উপকূলে নীল রক্তের এই প্রাণীর দেখা কম পাওয়া গেলেও শহরের ঝাউতলা রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের প্রদর্শনীতে বিভিন্ন আকারের ডজনখানেক জীবন্ত কাঁকড়া দেখা গেছে। এই কাঁকড়া কোত্থেকে ধরা হয়েছে জানতে চাইলে রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের পরিচালক শাহাদৎ হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন উৎস থেকে রাজকাঁকড়ার পাশাপাশি মাছসহ প্রায় ১৫০ প্রজাতির প্রাণী ধরে এনে প্রদর্শনীতে রাখি। এখানে আমাদের গবেষণা সেল ও ল্যাবরেটরি রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ অনেক সমুদ্র বিজ্ঞানী এখানে গবেষণা করেন।
তিনি জানান, সমুদ্র থেকে এসব প্রাণী আহরণের জন্য তাদের রেডিয়েন্ট ফিশ রিসোর্স-১ বা আরএসআর-১ নামের একটি জাহাজও রয়েছে; যেটা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সর্বোচ্চ দূরত্ব পর্যন্ত অনুসন্ধান চালাতে পারে। রাজকাঁকড়া নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে রাজকাঁকড়া ধরে আনার পর আমরা ট্রিটমেন্ট করি, এরপর প্রদর্শনীতে রাখি। আবার কয়েকদিন নুনিয়াছড়ার পরীক্ষামূলক ঘেরে ছেড়ে দিই।
তবে রাজকাঁকড়ার ঔষধি গুণাগুণ উন্মোচন করা গেলেও গত প্রায় ৭০ বছর ধরে চেষ্টা করেও পৃথিবীর কোথাও কৃত্রিম উপায়ে এ প্রাণীর প্রজনন করাতে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হননি বলে জানান সমুদ্র বিজ্ঞানী আশরাফুল হক। তিনি বলেন, ওষুধ শিল্পের জন্য প্রতি বছর কয়েক কোটি করে রাজকাঁকড়া শিকারের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে এই প্রাণী হারিয়ে গেছে। অনেক স্থানে এই প্রাণীর বিলুপ্তির সাথে সাথে এর ওপর নির্ভরশীল ওষুধ কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আশার কথা, এখনো বঙ্গোপসাগরের কিছু এলাকায় রাজকাঁকড়ার আবাসস্থল টিকে আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতি ভেদে ভারত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র উপকূল, ইন্দো-প্যাসিফিক, ইন্দোনেশিয়ান, আমেরিকান আটলান্টিক উপকূল এবং মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলে হর্সশো ক্র্যাব পাওয়া যায়। তবে পুরো বিশ্বেই এটি বিপন্ন।
রাজকাঁকড়া নিয়ে ১৯৫০ সাল থেকে আমেরিকায় গবেষণা শুরু হলেও দেশে কোনো গবেষণা হয়নি বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর জাহেদুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, এ প্রাণীটিকে টিকিয়ে রেখে কাজে লাগানো গেলে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার পাশাপাশি ব্লু ইকোনমি আরো শক্তিশালী হবে।
বিশ্বব্যাপী এই প্রাণীটি কাঁকড়া হিসাবে পরিচিত হলেও এর শারীরিক গঠন ও ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা একে কাঁকড়া বলতে নারাজ। তাদের মতে প্রাণীটি স্করপিয়ন (বিচ্ছু)।
সমুদ্র বিজ্ঞানী আশরাফুল হক জানান, বিশ্বে চার প্রজাতির রাজকাঁকড়া দেখা গেলেও আমাদের অঞ্চলে পাওয়া যায় টেচিপিয়াস ট্রাইডেন্টাতাস ও টেচিপিয়াস গিগাস প্রজাতির হর্সশো ক্র্যাব। তবে এগুলো অনেকটা দুর্লভ।
সূত্র জানায়, কয়েকটি আন্তঃদেশীয় পাচারকারী চক্র পাচার কাজে জড়িত। এ চক্রে রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি; যারা বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে এবং সমুদ্র দিয়ে চোরাই পথে পাচার করে দিচ্ছে রাজকাঁকড়া ও কাঁকড়ার নীল রক্ত। এ কাজে কিছু ফিশ ফার্ম জড়িত বলে সূত্রটি দাবি করেছে। গত মাসে বিজ্ঞানী নামধারী থাইল্যান্ডের কয়েকজন পাচারকারী রাজকাঁকড়ার সন্ধানে কক্সবাজারে আসে। তারা নীল রক্ত সংগ্রহের জন্য এসেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্রের দাবি, বঙ্গোপসাগর থেকে রাজকাঁকড়া ধরার পর কূলে এনে ল্যাবরেটরিতে সূক্ষ্ম উপায়ে রক্ত টেনে নেয়া হয়। সেই রক্ত সমুদ্র পথে স্পিডবোট বা ট্রলারে করে মাছ ধরা জাহাজে তুলে দেয়া হয়। মাঝ সাগরে মাছ ধরা ট্রলার থেকে থাইল্যান্ডগামী কার্গো জাহাজে তুলে দেওয়া হয় রক্ত। সেই সাথে লেজও। সাগরপথ ছাড়াও মাছসহ বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে নীল রক্ত পাচার হচ্ছে। তবে প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবে সংশ্লিষ্টরা পাচার কাজ চিহ্নিত করতে পারছেন না।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | ||
6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 |
13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 |
20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 |
27 | 28 | 29 | 30 | 31 |