babul_116044

ঢাকা ১০ জুন : যে সংগঠনের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, একাধিকবার কারাবরণ করেছেন, সেই সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। অনেকের কাছে এ ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও ধানমন্ডি থানা শ্রমিক দলের সভাপতি বাবুল সরদারের বেলায় তা-ই ঘটেছে।

অন্য দল বা সংগঠনের হাতে দলের কারো মৃত্যু হলে তাদের পরিবারের পাশে বিএনপি দাঁড়ালেও এখন পর্যন্ত ব্যতিক্রম বাবুলের পরিবারের বেলায়। ধানমন্ডি থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সামান্য কিছু অর্থ সহায়তার আশ্বাস ছাড়া গত এক মাসে এমনকি কোনো প্রতিশ্রুতিও মেলেনি তাদের।

গত ১৫ মে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে নিজ দলের লোকদের হাতে প্রাণ হারান সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী বাবুল সরদার।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে সাত বছরের যুবরাজ ও দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন বাবুলের স্ত্রী সাজেদা বেগম। কীভাবে সংসার চালাবেন, কেমন করে সন্তানদের মানুষ করবেন এই চিন্তায় দিশেহারা তিনি।

অথচ রাজনীতি-পাগল ছিলেন এই শ্রমিকনেতা বাবুল। কেউ কেউ বলেন, তিনি ২৪ ঘণ্টা রাজনীতি করতেন। ৩২টি রাজনৈতিক মামলার আসামি এই নেতা গত দিই দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাতবার কারাবরণ করেন। এমনকি রাজনীতির জন্যই তাকে বিক্রি করতে হয়েছে নিজের সম্বল রেন্ট-এ-কারটি।

জানা গেছে, ওই গাড়ি বিক্রির শেষ টাকাটা নিয়ে গত ১৫ মে সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন বাবুল। বিকালে শ্রমিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে নয়াপল্টন যান। সেখানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় সাদেক হোসেন খোকার রোগমুক্তি কামনায় আয়োজিত দোয়া মাহফিলে অংশ নেন। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে একে একে বিদায় দেন বাবুল।

পরে সংগঠনের আরেক নেতা আবু কাওসার ভুঁইয়াকে নিয়ে মোটরসাইকেলে উঠেন বাসায় ফেরার জন্য। কিন্তু মোটরসাইকেলে বসতে না বসতেই তাদের ওপর হামলা চালায় ১০-১৫ জন দুর্বৃত্ত। চাপাতি ও ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় তাদের দুজনকে। ধারালো চাপাতি দিয়ে কেটে দেয় বাবুল সরদারের হাত-পায়ের রগ। বেধড়ক পিটিয়ে ভেঙে দেয় কাওসারের হাত আর কুপিয়ে রক্তাক্ত করে দেয় তার মাথা।

এরপর তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সেখানে রক্তক্ষরণে মারা যান বাবুল সরদার। গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান কাওসার ভুঁইয়া। তারও হাতের রগ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা।

হাসপাতালে রক্তাক্ত বাবাকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ৭ বছরের শিশু যুবরাজ। কিন্তু যুবরাজের চেতনা ফেরার আগেই বাবুল চলে যান না-ফেরার দেশে।

তবে এখনো ছোট্ট যুবরাজকে তার বাবার মৃত্যুর কথা জানাননি  মা সাজেদা বেগম। বাবা বিদেশে চলে গেছেন বলে ছেলেক প্রতিনিয়ত  সান্ত্বনা দিচ্ছেন তিনি।

ছেলেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে পারলেও কোনো সান্ত্বনাই কাজে আসছে না কিশোরী মেয়ে বৃষ্টি মনির। তাদের এক প্রতিবেশী জানান, বাবার খুবই আদরের বৃষ্টি প্রায়ই একা একা নীরবে কাঁদে। পিতৃশোকে কাতর দশম শ্রেণীর এই ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া এখন বন্ধ।

বাবুলের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অকালে স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী সাজেদা বেগমের দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। দুই সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। স্বামীর মৃত্যুর এক মাস না পেরোতেই ছেড়ে দিয়েছেন ফ্ল্যাট বাসা। দুই সন্তানকে নিয়ে উঠেছেন মিরপুর এলাকায় কম ভাড়ার একটি টিনশেড বাড়িতে। দুই সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আঁতকে ওঠেন মাঝে মাঝে।

সাজেদা বেগমের বরাত দিয়ে তার প্রতিবেশী মিন্টু ঢাকাটাইমসকে বলেন, বরিশালের গৌরনদীর গ্রামের বাড়িতে ভিটামাটি ছাড়া বাবুলের পরিবারের আর কিছু্ নেই। সবই নদীভাঙনে চলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন তারা। স্বামী রাজনীতি করলেও ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন টেনেটুনে। গ্রামে থাকা বৃদ্ধ মা রিনা বেগমের ভরণ-পোষণও চালাতেন। কিন্তু কখনো রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিজের অভাব-অনটন বুঝতে দিতেন না।

এহেন একজন রাজনৈতিক কর্মীকে নিজ দলের একটি গোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হলো বলে অভিযোগ আছে। জানা যায়, বাবুল সরদার হত্যার পেছনে ধানমন্ডি থানা শ্রমিক দলের কমিটি বড় কারণ। গত ২৮ এপ্রিল ধানমন্ডি থানার ৫১ সদস্যবিশিষ্ট শ্রমিক দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটির সভাপতি করা হয় বাবুল সরদারকে।

এতে নাখোশ হন বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম। ওই সময় তিনি লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই ফোনে বাবুল সরদারকে টেলিফোনে নানা ধরনের হুমকি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে হুমকি পেয়ে অসীমের বিরুদ্ধে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন বাবুল সরদার। এতে আরোও ক্ষেপে যান অসীম। বিএনপি ও শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তিনি বাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন।

পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম খানের অনুরোধে হামলার দুই দিন আগে স্ট্যাটাসটি প্রত্যাহার করেন বাবুল সরদার।

কিন্তু তাতেও বাঁচতে পারলেন না বাবুল। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বাবুলের ওপর হামলায় ধানমন্ডি থানা শ্রমিক দল ও ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের ১০-১৫ জন অংশ নেয়। ঘাতকদের আরেকটি অংশ রাস্তার ওপারে পাহারায় ছিল। বেশির ভাগের চেহারাই পরিচিত।

হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর নাসিরউদ্দিন অসীমকে হুকুমের আসামি করে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন বাবুলের স্ত্রী সাজেদা বেগম।

মামলায় ধানমন্ডি থানা শ্রমিক দলের সিনিয়র সহসভাপতি শহিদুল্লাহ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শ্রমিক দলের যুগ্ম সম্পাদক বদরুল আলম সবুজসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ঘাতকদের কেউ গ্রেপ্তার হননি।

এমন অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করলে ওপাশ থেকে জানানো হয়, নাসির উদ্দিন অসীম এখনো লন্ডনে আছেন।

জানা গেছে, তার সতীর্থ নেতাকর্মীরা বাবুলের পরিবারের জন্য একটি ফান্ড সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে।

শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাসিম এ বিষয়ে ঢাকাটাইমসকে বলেন, “ধানমন্ডি থানা কমিটি নিয়ে ঝামেলা ছিল। কিন্তু এ নিয়ে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটবে এটা কেউ প্রত্যাশা করেনি। বাবুল আমাদের সংগঠনের একজন সক্রিয় ও নিবেদিত কর্মী ছিল। আমরা চেষ্টা করছি তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর।”

কবে নাগাদ এবং কোন ধরনের সহায়তা দেয়ার চিন্তা করছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করে শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা তার পরিবারকে ভালো একটা আর্থিক অনুদান দেয়ার চেষ্টা করব।”

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031