দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠা যানবাহন কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রাণ। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোই যাচ্ছে না।কেউ কেউ আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করে নিচ্ছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর শৃঙ্খলা ফেরাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। দায়সারা গোছের এসব উদ্যোগের বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি। ফলে এখনও সড়কে আগের বিশৃঙ্খলাই বিরাজ করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা বেড়েছেও। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কবে নাগাদ শৃঙ্খলা ফিরবে ঢাকার সড়কে।
গেল বছর বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খান ও করিমের মৃত্যুর ঘটনার পরপর সারাদেশে যখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গড়ে তোলে তখন সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। সংসদে সড়ক আইন ২০১৮ পাস হয়। সে আইন পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন সরকারেরই এক ক্ষমতাধর মন্ত্রীর সংগঠনের নেতারা বিরোধিতা করেন। আইনটি যেন বাস্তবায়ন না হয় সেজন্য দেশব্যাপী ধর্মঘট ডেকে জিম্মি দশায় ফেলে পুরো দেশবাসীকে।
এরপর সড়কে একের পর এক ঘটনা ঘটে গেছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়েও শতাধিক সড়কে শৃঙখলা ফেরাতে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় কমিটি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীও সবশেষ একনেক বৈঠকে সড়ক শৃঙ্খলার ফেরানোর নির্দেশ দেন। সর্বশেষ বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় ট্রাস্ট পরিবহনের একটি বাসের চাপায় পা হারানোর পর রাজধানীর গণপরিবহনের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সড়কের শৃঙখলা নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ আয়োজিত সেমিনারে বলেছেন, সমন্বয়হীনতার কারণেই সড়কে শৃঙখলা আনা যাচ্ছে না। অবস্থার উন্নতি করতে না পারলে সামনে তা আরও ভয়াবহ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
গত ২৬শে আগস্ট একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়ে বলেন, পণ্যবাহী কোনো যানবাহন বা ট্রাক যাতে ওভারলোড হয়ে সড়কে না উঠে সে জন্য সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে হবে। সড়কের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। একই ধরনের প্রকল্প যেন অনেকে বাস্তবায়ন না করে এই বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। এখন থেকে দেশের সব সড়কে ড্রাইভার-হেলপারদের জন্য সড়কের পাশে আধুনিক বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হবে। আমরা চাই যাতে কোনো চালক একটানা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালান।
এর আগে গেল বছর আগস্ট মাসেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৭টি নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনাগুলো ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সড়ক সংশ্লিষ্টরা কাজেও নামেন। তবে শেষতক বাস্তবায়ন হতে আর দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর ওই নিদের্শনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, রাজধানীর গণপরিবহন চলাকালে সবসময় দরজা বন্ধ রাখা এবং বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা নিশ্চিত করা, গণপরিবহনে (বিশেষত বাসে) দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন, ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালু। কিন্তু এক বছর পরও রাজধানীর গণপরিবহনের চিত্র বদল হতে দেখা যায়নি।
প্রগতি স্মরণিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় একইভাবে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা আবারো নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম এমনকি ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া তাদের বুঝিয়ে আন্দোলন স্থগিত করান। এরপর দুইবার মেয়রের কার্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি তোলা হলে সেগুলো মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন মেয়র। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ায় এসব উদ্যোগের খুব একটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাব মতে, গত এক বছরে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৩৮ শতাংশই পথচারী। ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১লা জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ এই হিসাব দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু বিমানবন্দর সড়কে মারা গেছেন ৪৬ জন।
সড়ক সংশ্লিষ্টদের মতে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও দালালদের দৌরাত্ম্য, পরিবহন সেক্টরের দুর্বৃত্তায়ন, বেপরোয়া চালকদের আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অভিযুক্ত চালক-মালিক ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের বিচার ও শাস্তি না হওয়া, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজের সমন্বয়হীনতা এবং ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের হাতে পরিবহন সেক্টর কুক্ষিগত থাকায় কোনোভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। শনিবার ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীর বাস ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ডিএমপি কমিশনার হিসেবে আমি গত পৌনে পাঁচ বছরে বাস মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বার বার বসেছি। বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করে আমরা সেগুলো থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজেছি। কিন্তু এর সঙ্গে বাস মালিক-শ্রমিক এবং পুলিশের বাইরেও সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। সেসব সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে আমরা কাঙ্খিত ফলাফল পাইনি। সড়কে বাস বে নেই উল্লেখ করে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বাস বে না থাকার কারণে গাড়িগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়েই যাত্রী উঠানামা করছে। এক্ষেত্রে হাজারো জরিমানা করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ ১৬৭ টা বাসস্ট্যান্ড চিহ্নিত করেছে। ফুটপাত দিয়ে যেন মোটরসাইকেল চলাচল করতে না পারে সেজন্য মেটাল পিলার স্থাপন করেছে। অথচ এগুলো ডিএমপির কাজ না হওয়া সত্ত্বেও নিজ অর্থায়নে ডিএমপি করেছে।