গত অক্টোবরে সমাপ্ত হওয়া দশম জাতীয় সংসদ কার্যকর বিরোধী দলের অভাবে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি । আইন প্রণয়ন কাজে সময় ব্যয় হয়েছে খুবই কম। আর বরাবরের মতো কোরাম সংকট ছিল। সংসদের ২৩টি অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে মোট ১৯৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট অপচয় হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৬৩ কোটি ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। দুর্নীতি বিরোধী গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পরিচালিত ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারির মাসে শুরু হওয়া প্রথম অধিবেশন থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবরে শেষ হওয়া ২৩তম অধিবেশনের (মোট ২৩টি) কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে তৈরি করা প্রতিবেদনে সংসদকে কার্যকর করতে ১১দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে বহুল আলোচিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
গতকাল ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
এসময় টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, টিআইবির উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে দশম জাতীয় সংসদ সম্পর্কে সার্বিক পর্যালোচনা উত্থাপন করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সংসদে আশা জাগানিয়ার মতো কিছু দেখিনি। সত্যিকারের বিরোধী দল না থাকায় দশম সংসদ প্রত্যাশিতভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তিনি বলেন, এই সংসদে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন পরিহার করলেও প্রকৃত বিরোধীদল বলতে যা বোঝায়, সে ভুমিকা আমরা দেখিনি। সেখানে বিরোধী দলের একটা আত্মপরিচয়ের সংকট ছিল। বলা যায়, মাথা ব্যাথার কারণে মাথা কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়নে খুব কম সময় ব্যয় করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। টিআইবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট ২৩টি অধিবেশনের মধ্যে কোরাম সংকটের কারণে ব্যয় হওয়া সময় মোট সময়ের ১২ শতাংশ। ২৩টি অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৮ মিনিট অপচয় হয়েছে। তবে গড় কোরাম সংকট আগের সংসদের তুলনায় কিছুটা কমেছে। অষ্টম সংসদে প্রতি কার্যদিবসে কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয় ৩৭ মিনিট, নবম সংসদে ৩২ মিনিট ও দশম সংসদে ২৮ মিনিট। নির্ধারিত সময়ে সংসদ অধিবেশন শুরু না হওয়ায় এই অপচয় হয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। তবে সংবিধান অনুযায়ী, নূন্যতম ৬০ জন সদস্য উপস্থিত না থাকলে সংসদের কোরাম হয় না।
কোরাম না থাকলে বৈঠক স্থগিত বা মুলতবি করতে হয়। আর জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে বলা আছে, কোরাম সংকটের জন্য অধিবেশনে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোরাম হওয়ার জন্য তিনি পাঁচ মিনিট ধরে ঘণ্টা বাজানোর নির্দেশ দেবেন। এর মধ্যে কোরাম না হলে স্পিকার অধিবেশন মুলতবি রাখবেন। এদিকে ১০ম সংসদের পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে এমপিদের পেশা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ওই সংসদে ব্যবসায়ি ৫৯ ভাগ, আইনজীবি ১৩ ভাগ, রাজনীতিক ৭৮ ভাগ, অন্যান্য ২১ ভাগ (শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিনী,পরামর্শক)। প্রতিবেদনে জাতীয় পার্টির দ্বৈত অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়, একদিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের পরিচয় অন্যদিকে সরকারের অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্তি-নিজেদের অবস্থান নিয়ে পরিচিতির সংকট। এসব কারনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
আইন প্রণয়নে কম সময় ব্যয়: প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে,সংসদ সদস্যদের বলা হয় আইন প্রণেতা। তবে জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত আলোচনাতেই সবচেয়ে কম সংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নেন। সংসদের ৩৫০ জন সদস্যের মধ্যে আইন প্রণয়ন (বাজেট ব্যতিত) আলোচনায় মাত্র ৯৪ জন অংশ নিয়েছেন। ফলে এতে কম সময় ব্যয় হয়েছে। দশম সংসদের ২৩টি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কাযক্রমে ১৬৮ ঘণ্টা ১২ মিনিট সময় ব্যয় হয়। যা অধিবেশনগুলোর ব্যয় হওয়া মোট সময়ের ১২ শতাংশ। আর আইন প্রণয়ন কার্যক্রম বিল পাসের আলোচনায় সরকারি দল ১১ শতাংশ, প্রধান বিরোধী দল ৬৭ শতাংশ এবং অন্যান্য বিরোধী দল ২২ শতাংশ সময় ব্যয় করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সংসদে ১৯৩ টি সরকারি বিল পাস হয়েছে। এর মধ্যে সংশোধনী বিল ছিল ৫১টি। তবে ১৬টি বেসরকারি বিল উত্থাপিত হলেও কোনটি পাস হয়নি। বিলগুলো উত্থাপন, বিলের ওপর সংসদ সদস্যদের আলোচনা ও মন্ত্রীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে একটি বিল পাস করতে গড়ে সময় লেগেছে ৩১ মিনিট। দশম সংসদে ৭১ শতাংশ বিল পাশ হয়েছে এক থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে। যেখানে পাশের দেশ ভারতের ১৬তম লোকসভায় প্রতিটি বিল পাসে গড়ে ১৪১ মিনিট ব্যয় হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আইন পাশ হওয়ার ফলে সংসদ সদস্যরা আইনটি সম্পর্কে ভালোভাবে পড়েছেন কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি: দশম সংসদে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ৬২ শতাংশ। আর নারী সদস্যদের উপস্থিতি ৭১ শতাংশ। সংসদ নেতা শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিল ৮২ শতাংশ। আর বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের উপস্থিতি ছিল ৫৯ শতাংশ। অধিবেশনের কোনোটিতে প্রধান বিরোধী দল বা অন্যান্য বিরোধী সদস্য সংসদ বর্জন করেননি। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী দলীয় সদস্যরা ১৩বার ওয়াকআউট করেন। এ সময় সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা, আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তারা মন্ত্রিপরিষদের অংশ হওয়ায় সংসদে জোরালো ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। আগের সংসদগুলোর মতো এই সংসদেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কটুক্তি, আক্রমণাত্মক ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্পিকারের যথাযথ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
টিআইবি’র ১১দফা সুপারিশ: গবেষণা প্রতিবেদনে সংসদকে কার্যকর করতে ১১দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, নিজ দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট ও বাজেট ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে সদস্যদের নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দেয়ার সুযোগ রেখে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদ সদস্য আচররণ আইন প্রণয়ন এবং সরকারি দলেল একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিববর্তে কার্যকর বিরোধীদলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারকে বিধি অনুযায়ী রুলিং প্রদান ও অসংসদীয় ভাষা এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে আরো জোরালো ভূমিকা পালন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশযোগ্য নয় এমন বিষয় ছাড়া আন্তজার্তিক চুক্তিসমূহ প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপন এবং আইরেনর খসড়ায় জনমত গ্রহণের জন্য অধিবেশনে উত্থাপিত বিলসমূহ সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। সংসদীয় কমিটির কার্যকারিতা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করে সুপারিশে বলা হয়েছে, কোন সংসদীয় কমিটিতে কোনও সদস্যের স্বার্থ সংশ্লিস্টতার তথ্য পাওয়া গেলে তাকে ওই কমিটির সদস্য পদ বাতিল, বিধি অনুযায়ী কমিটির প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটিসহ জাতীয় বাজেটে তুলনামূলকভাবে বেশি আর্থিক বরাদ্দপ্রাপ্ত শীর্ষ ১০টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মধ্যে অর্ধেক কমিটির সভাপতি হিসেবে বিরোধীদলীয় সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত না হলে কমিটির পরবর্তী সভায় এর কারণ লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানানোর বিধান চালু এবং সংসদ সদস্যদের সম্পদের প্রতিবছরের হালনাগাদ তথসহ সংসদের বাইরে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য স্বপ্রনোদিতভবে উন্মুক্ত করতে হবে।