চট্টগ্রাম ০৫ জুন : দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একাধিক জেএমবি সদস্য ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন সম্প্রতি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া এই কর্মকর্তা।জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের আতঙ্ক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার।
এজন্য হুমকিও পেয়েছেন একাধিকবার। তবে দমে যাননি অদম্য সাহসী এই মানুষটি। তার পরিবারের সদস্যরাও ব্যক্তিগত আলাপে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তার কথা প্রকাশ করেছিলেন। চট্টগ্রামের জিইজি মোড়ে যে বাসায় বাবুল আক্তার পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তার স্ত্রী তা বদল করার কথাও আশপাশের বাসিন্দাদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তি সব কেড়ে নিয়েছে। রবিবার সকালে দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে।
স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ বাবুল আক্তার। ঢাকায় বসে দুঃসংবাদটি শুনে তিনি বারবার জ্ঞান হারিয়েছেন। পরে র্যাবের বিশেষ হেলিকপ্টারে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। হাসপাতালে প্রিয়তম স্ত্রীর নিথর মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সহকর্মী ও সাধারণ মানুষের অসম্ভব প্রিয় এই মানুষটি তখন কেউ সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পায়নি। শক্তিমান এই মানুষটি শোকে দুর্বল হয়ে পড়েন।
অথচ গত বছর ৭ অক্টোবর পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের মিশন সফল করে বীরদর্পে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। যাতে তিনি পেশাগত কাজ করতে গিয়ে নানা বাধা বিপত্তির পাশাপাশি পরিবারকে সময় দিতে না পারার আক্ষেপ ছিল।
ওই সময় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কূলকিনারাহীন (ক্লু-লেস) পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন এবং এই রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে সন্ধান করেছেন জঙ্গি আস্তানার। এই ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আত্মঘাতী গ্রেনেড হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন বাবুল।
নিজের এবং সহকর্মীদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন পাঁচ জঙ্গিকে। উদ্ধার করেছেন বিপুলসংখ্যক হ্যান্ড গ্রেনেড, অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক। এজন্য তাকে চেষ্টা করতে হয়েছিল একমাস।
ফেসবুকে তার ওই সময়ের সেই আবেগঘন স্ট্যাটাসটি সিটিজি টাইমসের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
“কিশোর বয়সে পড়ার টেবিলে বসে চুরি করে শার্লক হোমস পড়তে পড়তে রহস্যের দুনিয়াতে হারিয়ে যেতাম। ভাবতাম কত সহজেই শার্লক হোমস রহস্যের জট খুলে ফেলে। কিশোর পেরিয়ে যৌবনে এসেছি সে মেলা দিন। পুলিশে এসেছি তাও ১০ বছর পেরিয়ে গেল। এখন বুঝি শার্লক হোমস হওয়া কত কষ্টের, কত সাধনার। একটা জটিল রহস্যের জট উন্মোচন করা হিমালয় ডিঙ্গানোর চেয়ে কম নয়।
বায়োজিদ থানা এলাকায় গত মাসের ল্যাংটা ফকির ও তার খাদেম খুন হওয়ার পর থেকে সেই যে ঘুম হারাম হল। এরই মধ্যে আবার সদরঘাট থানাতে ঈদের ১ দিন আগে ঘটে গেল তিন খুন!! পুরো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ঘুম হারাম।
নানা সূত্র ধরে এগুতে এগুতে টানা পরিশ্রম করতে হয়েছে। রাতে বাসায় না ফিরে, সন্তানদেরকে নানা কথায় ভুলিয়ে নগরে, বন্দরে, গ্রামে, পাহাড়ে, অলি গলিতে হেঁটে, কাদাপানি মাড়িয়ে সবশেষ দেখা মিলল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের। আটক হল ৫ জঙ্গি। উদ্ধার হলো ৯টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১২০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি ও জিহাদি বই, জঙ্গিদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল।
অল্পের জন্য জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড হতে বেঁচে গেলাম আমি, আমার টিমের পাঁচ সদস্য এবং বাড়িওয়ালার স্ত্রী। পেলাম নতুন জীবন, শুকরিয়া স্রষ্টার।
আটক জঙ্গিরা স্বীকার করলো উক্ত পাঁচ হত্যাকাণ্ডের কথা। তাদের কথামত উদ্ধার হলো ন্যাংটা ফকির ও তার খাদেম হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা ও রক্তমাখা কাপড় চোপড় ও বাইসাইকেল। ছিনতাইয়ের সময় (ত্রিপল মার্ডার) ব্যবহৃত মোটরসাইকেল।
শেষ হলো একটি মাসের পরিশ্রম, উন্মেচিত হলো জমাট বাঁধা রহস্য, যে রহস্যের ছিল না কোনো কূল কিনারা ( ক্লু-লেস ক্রাইম)। যে রহস্যের শুরু হয়েছিল বায়োজিদে, সে রহস্য শত মাঠ ঘাট, শহর, বন্দর, পাহাড়, নদী পার হয়ে এসে শেষ হলো কর্ণফুলির খোয়াজনগরে।
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের অভিযান শেষে ক্লান্তি এসে ভর করত কিনা জানি না তবে আমার মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে। তারপরও সবসময় বলি “ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো হে প্রভু”।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পুলিশের ২৪তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন র্যাব-২ এ।
২০০৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগ দিয়ে দুর্ধর্ষ ক্যাডারবাহিনী দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আলোচনায় আসেন।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার একটি দুধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনীকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেন আলোচিত কর্মকর্তা বাবুল আক্তার। হাটহাজারী সার্কেলে সাফল্যজনক ভূমিকা রেখে পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে দায়িত্ব পালন করে। এই জেলাতেও তিনি অপরাধ দমনে প্রসংশনীয় ভূমিকা রেখে পুলিশ বাহিনীর সুনাম বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন।
পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার থেকে বদলি হয়ে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরে একই সালের ১৪ জুলাই সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদান করেন। মিশনে এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত দেড়মাস পূর্বে বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর ও দক্ষিণ জোনে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে যোগ দেন।