আমাজন গত দুই সপ্তাহজুড়ে জ্বলছে পৃথিবীর সবথেকে বড় রেইনফরেস্ট । পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে শত শত কিলোমিটার বনভূমি। প্রতি মিনিটে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ফুটবল মাঠের সমান বনাঞ্চল। অথচ পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত এই বনাঞ্চলকে বাঁচাতে যে উদ্যোগ দেখা গেছে তা অতি সামান্য। এখনো দেখা যায়নি বড় ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। ব্রাজিল সরকারের ভূমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত আমাজনে কমপক্ষে ৭৩ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে পুরো ২০১৮ জুড়ে এ সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের কম। এই একই সময়ের হিসেবে গত বছরের তুলনায় এবার আমাজনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৩ শতাংশেরও বেশি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। কিন্তু তিনি উলটো দাবি করছেন, তার ভাবমূর্তি খারাপ করতে প্রতিপক্ষ আমাজনে এ আগুন লাগিয়েছে। বলসোনারো বলেন, এই আগুন ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানো হয়েছে। সমগ্র আমাজন জুড়ে এই অবস্থা। এটা কীভাবে সম্ভব? সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সেখানে মানুষ যাচ্ছে এবং আগুন লাগিয়ে তার ভিডিও তৈরি করছে। আমার মন এখন এটাই বলছে।
তবে আসল অভিযোগের তীর বলসোনারোর দিকেই। আমাজন নিয়ে তার ব্যবসাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা প্রকাশ্যেই তিনি বলেছেন বেশ কয়েকবার। নির্বাচনী প্রচারণার সময়েও তিনি আমাজনকে মাইনিং ও কৃষিকাজের জন্য ব্যবহারের কথা বলেন। এ ছাড়াও তিনি প্রচণ্ড মাত্রায় আদিবাসীবিরোধী একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে আমাজনের এই অবস্থার জন্য স্থানীয়রা মনে করেন বলসোনারোই এর পেছনে দায়ী। রনডোনিয়া প্রদেশের পরিবেশ ও আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন কানিন্দে এসোসিয়েশন। তার এক সদস্য ইভানেইদে বানদেইরা বলেন, এখানকার অবস্থা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। বন ও আদিবাসীদের ভূমিতে আগুন লাগানোর জন্য আমি এই সরকারকেই দোষারোপ করছি। এখানকার আকাশ সমপূর্ণ কালো হয়ে আছে। হাসপাতালগুলো অসুস্থ মানুষে ভরে যাচ্ছে। আমাজনে থাকা সব আদিবাসী এলাকায়ই আগুনের প্রভাব পরেছে। তিনি আরো জানান, রাতের বেলা তিনি নিজেও নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ঘুম থেকে ওঠে গেছেন। তার ভাষায়, এখন আমাজনে যা হচ্ছে তা পূর্বের অগ্নিকাণ্ডগুলোর থেকে হাজারগুণ বেশি ভয়াবহ। কোনো কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা হতে পারে না। যে সন্ত্রাসীরা এই আগুন লাগাচ্ছে তারা সবাই সরকারের আশ্রয়ে থাকে। সরকার আমাজনকে পোড়াচ্ছে, বনাঞ্চল ধ্বংস করছে। অপরদিকে আমাজন রক্ষায় যারা কাজ করছে তাদেরকে দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে।
লাতিন আমেরিকার সবথেকে বড় শহরগুলোর একটি ব্রাজিলের সাও পাওলো। আমাজনের আগুনের ধোঁয়ায় এ শহরের দিন রাত এখন আলাদা করা কঠিন হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাজনের জন্য প্রার্থনার দাবিতে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু বাস্তবে কেউ এগিয়ে আসছে না। ইতিমধ্যে যে পরিমাণ বনাঞ্চল পুড়ে গেছে তা গত দুই বছরে ঘটা লক্ষাধিক অগ্নিকাণ্ডের থেকেও বেশি।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর
আমাজনের প্রায় ৭৫০০ কিলোমিটার বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে, যা ২০১৭ সালের তুলনায়
৬৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের আপাত পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, আমাজন
বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার এই হার প্রেসিডেন্ট বলসোনারো গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায়
আসার পর তিনগুণ হয়ে গেছে। বিবিসি জানিয়েছে, শুধুমাত্র গত মাসেই ২২০০
কিলোমিটার বনাঞ্চল খালি করা হয়েছে, যা গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় ২৮০
শতাংশ হারে বেশি। এ নিয়ে কট্টর ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত বলসোনারো প্রকাশ্যে
এসব তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একইসঙ্গে এজেন্সির পরিচালক রিকার্ডো
গ্যালভাওকে বরখাস্ত করে বিতর্ক আরো চাঙ্গা করেছেন।
স্যাটেলাইট থেকে
পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আমাজনের কমপক্ষে ৯৫০০ স্থানে
আগুন জ্বলছে। অর্থাৎ, মানুষ যা ভাবছে অবস্থা তার থেকেও অনেক বেশি ভয়াবহ।
সবথেকে খারাপ অবস্থা ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ রোরাইমার। এর বেশিরভাগ
এলাকা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে আছে। এর রাজধানী মানাউসে এ নিয়ে জরুরি অবস্থা জারি
করা হয়েছে। এ ছাড়া, পেরু সীমান্তেও জারি রয়েছে পরিবেশগত উচ্চ সতর্কতা।
প্রায়
২.১২ মিলিয়ন বর্গ মাইলের রেইনফরেস্ট এই আমাজন পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত।
ব্রাজিল, কলোম্বিয়া, পেরু ও অন্য বেশ কয়েকটি দেশজুড়ে অবস্থিত এই বন।
পৃথিবীর চার ভাগের একভাগ কার্বন ডাই অক্সাইড আমাজনই গ্রহণ করে থাকে। এখন
এটি এমন এক হুমকির মুখে পড়েছে যা এর আগে কখনো ছিল না। গবেষকরা বলছেন, এর
পরিণতি হবে ভয়াবহ। পারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পরিবেশ বিজ্ঞানী ভিটোর
গোমেজ বলেন, এত বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমার আর জানা নেই। শুধুমাত্র
প্রাকৃতিক কারণে এত বড় আগুন একেবারেই অসম্ভব। এটা কোনো শুষ্ক মৌসুমও না।
প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ব্রাজিলের অর্থনীতি চাঙ্গা করার আশ্বাস দিয়ে আসছেন।
কিন্তু আমাজন নিয়ে তার যে অবস্থান তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষার
আন্দোলনে ব্রাজিলের ভাবমূর্তি সমপূর্ণ নষ্ট করে দিচ্ছে।