রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার জন্য যারা প্ররোচনা দিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়াকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একেএম আব্দুল মোমেন বলেছেন, যারা ইংরেজিতে পোস্টার-প্লেকার্ড লিখে সাপ্লাই দিয়েছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান না পাঠানোর আহবান জানিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে সরকার। দ্বিতীয় দফায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও প্রত্যাবাসন না হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী এভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। গতকাল বিকালে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমরা আশা করেছিলাম স্বল্প আকারে হলেও প্রত্যাবাসনটা শুরু হবে। কিন্তু তা হয়নি।

আমরা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছি। সমস্যাটা তৈরি করছে মিয়ানমার, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। আমরা জোর করে কিছু করতে চাই না। প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, জয়েন্ট কমিশনের চতুর্থ বৈঠকে আমরা মিয়ানমারকে স্পষ্ট করে বলেছিলাম যে এখানে ট্রাস্ট ডেফিসিট বা আস্থার সঙ্কট আছে। বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। এখানে যারা রোহিঙ্গাদের নেতা আছে, মাঝি আছেন তাদের শ’খানেককে আপনারা রাখাইনে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে একটি শঙ্কা আছে। তারা মনে করে রাখাইনে এখনও তাদের সিকিউরিটি এবং সেফটির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা হয়নি। মিয়ানমার বলছে তারা সেখানে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এটা এখন তাদের নিয়ে গিয়ে দেখাক তারা তাদের নিরাপত্তায় সেখানে কি আয়োজন করেছে। কতটা তাদের সেফটি ব্যবস্থা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, এবারই প্রথম প্রত্যাবাসনের আয়োজনে মিয়ানমারের প্রতিনিধি কক্সবাজারে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে চীনের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।

আমাদের তো আছেনই। আমরা সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আমাদের কোথাও কোন ঘাটতি বা গাফলতি নেই। মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল রোহিঙ্গারা যে শর্ত দিচ্ছে তা পূরণের আগে তাদের ফেরত পাঠানো ঠিক হবে কি-না? জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের দাবি দাওয়ার বিষয়ে হোস্টেজ বা জিম্মি হতে পারি না। তাদের ডিমান্ড নিজের দেশে ফিরে গিয়েই তাদের অর্জন করতে হবে। এ জন্য তারা আমাদের জিম্মি করতে পারে না। যারা প্ররোচনা বা নেগেটিভ ক্যাম্পেইন করছে রোহিঙ্গাদের না যাওয়ার জন্য, তাদের বিষয়ে সরকার কি কোন পদক্ষেপ নিবে? জানতে চাইলে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেবো। যারা লিফলেট বিতরণ করেছে, ক্যাম্পেইন করছে না যাওয়ার জন্য আমরা তাদের চিহ্নিত করছি এবং অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বলেছে তাদের যাওয়া ঠিক হবে না। তাদেরকে বলছে দাবি করো। ইংরেজীতে সাইনবোর্ড  লিখে দিচ্ছে, অবশ্যই আমরা তাদের  আইডেন্টিফাই করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী ফের বলেন, না, আমাদের নতুন কোন প্রস্তাব নয়। আমরা যেটা বলেছি সেটা অনেক আগেই বলেছি। আসিয়ানরাও এটা জানে, যে এখানে একটি আস্থার সঙ্কট আছে। এটা দূর করতে হবে। রোহিঙ্গারা এখানে আরাম আয়েশে আছে, এটা ফেলে তারা যাবে বলে তিনি মনে করেন কি? প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আগামীতে এত আরাম থাকবে না। কারণ অনেক দিন হয়ে গেলে এটা থাকে না। এখন অনেকে সাহায্য-সহায়তা দিচ্ছে। সরকার নিজে থেকে প্রায় আড়াই-তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। আগামীতে এটা থাকবে না। সুতরাং যারা যেতে চাইছে না তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যই ভাবা উচিত এবং ফিরে যাওয়া উচিত।

ভাষানচরেও তো তারা যেতে রাজী নয়। এত টাকা খরচ করে সরকার সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে তাদের সরিয়ে নেয়ার বিষয়েও তো সরকার শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না, কেন? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এখন আমরা এ ব্যাপারে শক্ত হবো। তবে মন্ত্রী জোর দিয়েই বলেন, প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের চেষ্টা জোরকদমেই চলবে। যে প্রক্রিয়াটা ২২ শে আগস্ট শুরু করার চেষ্টা ছিল, কিন্তু পারলাম না সেই চেষ্টায় কোন বিরতি হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, প্রক্রিয়াটা শুরু হলেও সবাইকে পাঠাতে অনেক দিন লাগবে। মিয়ানমার যেটা নির্ধারণ করেছে সব লোক ফেরত যেতে দু’বছর লাগার কথা। ২২ শে আগস্ট শুরু হলে ভাল হতো। কিন্তু হয়নি। আমরা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটা ধরে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই। নাগরিকত্ব এবং রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকারী বর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তি না হলে বাস্তুচ্যুতরা ফিরে না যাওয়ার যে গো ধরেছে সে বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার তো বলেছে তারা ফিরে গেলে একটা কার্ড দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া চালু হবে। একটা পর্যায়ে তারা নাগরিকত্ব পাবে। এখানে বাংলাদেশের কিছুই করার নেই। দ্বিতীয়তঃ তারা চায় শাস্তি। তাদের ওপর যারা নির্যাতন করেছে তাদের বিচার। তাতো আমরা করতে পারি না, মন্তব্য পররাষ্ট্র মন্ত্রীর। রোহিঙ্গা ঢলের দু’বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বছরপূর্তির ওই সময়ে কি তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন যে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের এত উদারতা দেখানো ভুল হয়েছে? মন্ত্রী বলেন, না, ভালমন্দ দু’দিকেই আছে। মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। আমরা মনে করেছিলাম তারা কথা রাখবে।

আগে কিন্তু মিয়ানমার কথা রেখেছিল। তারা ১৯৭৮ সালে ফেরত নিয়েছে। ৯২ সালেও ফেরত নিয়েছে। ১৯৯২ সালে এসেছিল মোটামুটি প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার। তখন ২ লাখ ৩০ হাজারকে তারা ফেরত নিয়েছিল। মন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার কিন্তু কখনও বলেনি যে তারা এদের ফেরত নেবে না। সাংবাদিকরা বলেন, কিন্তু রোহিঙ্গাদের শর্তগুলোই বাধা! এটা নিরসন হবে কিভাবে? জবাবে মন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারকেই এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা সত্যিকারভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আয়োজন করেছে। আমি মনে করি তারা যদি রাখাইনে সত্যিই কোন উন্নতি করে থাকে সেটা লোকজনকে নিয়ে গিয়ে দেখাক। রাখাইনে আসলে কি উন্নয়ন করেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য কি বব্যস্থা করেছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য কি আয়োজন রয়েছে, সেটা তাদের দেখাক। বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যেতে পারে। এতে আস্থার সঙ্কট দূর হবে এবং রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজী হবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা চিন্তা করছি বিভিন্ন দেশের লোককে নিয়ে একটা কমিশন গঠন করব। তারা রাখাইনে যাবে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। তারা যদি সৎ হয় অবশ্যই সেখানে সব কিছু দেখাবে। মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল আগের দুটো প্রত্যাবাসনই তো বিএনপির আমল (৭৮, ৯২)। এবারে আমরা বেশী নরম হচ্ছি কিনা? এমন প্রশ্নে মন্ত্রীর সাফ জবাব না, অবশ্যই আমরা নরম না।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031