দেশের অর্ধেকেরই সাগর পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন নেই লাইটারেজ জাহাজগুলোর । নেই সক্ষমতাও। চালকদের মধ্যে অনেকেরই নেই দক্ষতা। তবুও পাড়ি জামাচ্ছেন সাগরে। এছাড়া জাহাজ নির্মাণে প্রচলিত নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করায় কোটি কোটি টাকার পণ্যসহ একের পর এক লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটছে। একই দিনে পাঁচটি লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনার জের ধরে বিশেষজ্ঞরা এসব মন্তব্য করে বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতটিতে নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের নানা দেশ থেকে ভোগ্য পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদারভ্যাসেল গুলো বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। এসব জাহাজ থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করে কর্ণফুলী নদীর ষোলটি ঘাটের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজের সাহায্যে বিদেশি মাদার ভ্যাসেলের পণ্য খালাস কার্যক্রম চলে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন বার্থিং সভা করে ডব্লিউটিসি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে চাহিদানুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়। যেগুলো বহির্নোঙরে গিয়ে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করে। অপরদিকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং পণ্যের এজেন্টরা ডব্লিউটিসির সিরিয়ালভুক্ত না হয়ে নিজেদের মতো করে নিজেরা জাহাজ পরিচালনা করেন।
সবকিছু মিলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হাজার দেড়েক লাইটারেজ জাহাজ দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনে জড়িত। দেশের আমদানি বাণিজ্যের আশি শতাংশেরও বেশি পণ্য পরিবাহন হয় এই বন্দর দিয়ে। এর বেশির ভাগই পরিবহন করা হয় লাইটারেজ জাহাজে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক এই জাহাজের অধিকাংশেরই সাগর পাড়ি দিয়ে চলাচল করার মতো অবকাঠামোগত সক্ষমত নেই। কোনো ধরনের নিয়ম কানুন অনুসরণ না করেই জাহাজগুলো চলাচল করতে গিয়ে প্রায়শঃ কোটি কোটি টাকার পণ্য নিয়ে নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে সম্প্রতি একই দিনে পাঁচটি লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে চলাচল করতে গেলে নেভাল আর্কিটেক্ট প্রণীত ডিজাইন অনুসরণ করে জাহাজ নির্মাণ করতে হয়। এসব জাহাজ অনুমোদনের আগে সার্ভেসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদে জাহাজগুলোর ফিটনেস পরীক্ষার বিধানও রয়েছে। এছাড়া নিয়মিত রঙ, ডকে নিয়ে সংস্কার ও মেরামত করাসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। যা মনিটরিং করার জন্য সরকারের বিভাগ রয়েছে। রয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও। অথচ এসব নিয়ম কানুনের খুব বেশি অনুসরণ করা হয় না। জাহাজ খুলনা থাকলেও ঢাকা থেকে সার্ভে রিপোর্ট প্রদান করা হয়। জাহাজ চট্টগ্রাম থাকলেও রিপোর্ট দিয়ে দেয়া হয় ঢাকায় কর্মকর্তা জাহাজ পরিদর্শন করেছেন বলে। এতে কাগজে কলমে ঠিকঠাক থাকা জাহাজগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে উঠে। আর এই নাজুক জাহাজ সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে তলিয়ে যায়। একই সাথে কোটি কোটি টাকার পণ্যও ভেসে যায় পানিতে। অথচ নিয়মকানুন মেনে জাহাজগুলো নির্মিত হলে এ ধরনের অঘটন ঘটত না বলে বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
অপরদিকে টাকা দিয়ে মাস্টারের সনদ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর দক্ষতা যাছাই করে মাস্টারের সনদ দেওয়া হয়। অথচ এসব পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের গোঁজামিল রয়েছে। বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো মাস্টারের সনদ জুটে যাচ্ছে। এসব অদক্ষ চালক জাহাজ নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন।
সূত্র বলেছে, লাইটারেজ জাহাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমের বহুলাংশ লাইটারেজ জাহাজের উপর নির্ভরশীল। এ খাত নিয়ে উদাসিনতা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা লাইটারেজ জাহাজের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যেকোনো ভাবে জাহাজ সাগরে নামিয়ে দিলে তা ঝুঁকির সৃষ্টি করে। এতে শুধু কয়েক কোটি টাকা দামের জাহাজই নয়; সাথে পণ্য এবং বহু মানুষের অমূল্য জীবনও হুমকির মুখে পড়ে।
ডব্লিউটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা জাহাজের মান পরীক্ষা করি না। আমাদের এখানে জাহাজের সিরিয়াল দেওয়া হয়। পণ্যের এজেন্টরা চাহিদা দেন। আমরা চাহিদানুযায়ী জাহাজের বরাদ্দ দিই। তবে যথাযথ নিয়মকানুন অনুসরণ করে জাহাজ তৈরি এবং পরিচালনা করা না হলে তা সবার জন্যই ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।