রাস্তায় প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা ঢাকা । ঝরছে প্রাণ। কখনও ওভারটেকিং, কখনও গতির প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ। বেপরোয়া যানবাহনগুলো ফাকা রাস্তা পেলে গতি দানবে পরিণত হয়। কখনও কখনও ফুটপাতে উঠে যায় বেপরোয়া গাড়ি। সদ্য অতীতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তীব্র আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা। আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই আন্দোলনের পরে দুর্ঘটনা রোধে নানা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। প্রতিদিন জরিমানা করা হচ্ছে আইন ভঙ্গকারী যানবাহন চালকদের।
তবুও দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব দিক থেকে ঢাকাকে পথচারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক একটি শহর বলে মনে করেন অনেকে।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের হিসেব অনুসারে ঢাকা শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের প্রায় সবাই পথচারী। বেশিরভাগই রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের চাপায় মারা যান। অনেক পথচারী যেমন নিয়ম না মেনে যততত্র রাস্তা পার হন, তেমনি অনেককে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়েও গাড়ির চাপায় জীবন দিতে হয়েছে। ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২০০ জন। ২০১৮ সালে মারা যায় ২০৬ জন। চলতি বছরের ছয় মাসে এই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১৯৬ জন।
এরমধ্যে প্রায় সবাই
পথচারী। ২০১৭ সালে নিহতের মধ্যে ১৪২, ২০১৮ সালে ১৪০ ও চলতি বছরের ছয় মাসে
১০৯ জনই পথচারী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে আন্তর্জাতিকভাবে সড়ক
দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৫২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের
মতো উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে এর পরিমাণ ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
দুর্ঘটনার
জন্য রাস্তা ও সড়কে রিকশা, মোটরসাইকেল এবং সিএনজি অটোরিকশাকে দায়ী করেছেন
বাস চালকরা। উইনার নামক বাসের চালক রহিম উদ্দিন জানান, রাস্তায় প্রায়ই গর্ত
খুঁড়ে তা অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়। উন্নয়ন কাজের নামে ওয়াসা, সিটি
করপোরেশনসহ বিভিন্ন সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠান এসব গর্ত খুঁড়ে। সারাবছরই
এই খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে। একইভাবে সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশা চালকদের দায়ী
করেন এই চালক। তারা কোনো কিছু না বুঝে এমনকি দুই পাশে না দেখেই রিকশা ও
অটোরিকশা দ্রুত টান দিয়ে অন্য যানবাহনগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নিশাত রহমান বলেন, সড়কে বিভিন্ন গর্তে যখন পানি জমে থাকে, দুর্ঘটনা এড়াতে আমরা সেই পানি নিষ্কাশনের কাজও করি। যদিও এটা অন্যদের কাজ, দুর্ঘটনা এড়াতে আমরা তা করি। এছাড়া মামলা ছাড়াও আইন মানতে সবাইকে উদ্বুদ্ব করতে নানা ধরণের সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণ ব্যাখা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরমধ্যে অন্যতম অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং। যাত্রী উঠানোর প্রতিযোগিতায় নেমে বাস চালকরা একে অন্যকে ওভারটেকিং করার প্রতিযোগিতায় নামেন। এতে বাসের মধ্যে প্রায়ই সামনে-পেছনে ধাক্কা লাগে। গ্লাস ভাঙ্গে। অনেক সময় যাত্রীরা আহত হন। এটি নিত্য দিনের ঘটনা। কখনও কখনও বাস উল্টে যায়। আহত-নিহত হন পথচারী ও রিকশাচালকরা। গুলিস্তান, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, দৈনিকবাংলা, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, উত্তরা এলাকায় এলাকায় বাসের এই ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বাসগুলোর অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনও এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিভিন্ন ছুটির দিনে, সপ্তাহের শুক্রবারে ও গভীর রাতে ফাকা রাস্তায় গতির প্রতিযোগিতায় নামে অভিজাত শ্রেণির তরুণরা। ওই সময়ে উল্লেখ যোগ্য দুর্ঘটনা ঘটে ঢাকায়।
বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, একটি আধুনিক নগরীতে মোট
আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র সাত থেকে
আটভাগ। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য রাস্তার অপ্রশস্ততা অন্যত কারণ। গণপরিবহনের
চেয়ে প্রাইভেট গাড়ি বাড়ছে। অদক্ষ চালকদের হাতে দেয়া হচ্ছে এসব গাড়ি।
একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে তরুণরা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
তাদের অনেকে মারা যাচ্ছে, অনেকে পঙ্গু হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম ঝুঁকির মধ্যে
রয়েছে। ঢাকার সড়কে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
অধ্যাপক
শামসুল হক বলেন, দৈর্ঘে ঢাকা শহর ২০ কিলোমিটার অন্যদিকে আড়াআড়িভাবে ৯
কিলোমিটার। এই সামান্য জায়গায় বাড়ছে গাড়ি, মানুষ। কেউ শৃঙ্খলা মানতে চান
না। গণ-পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করেছে। আবার ফুটপাত বলে কিছু
থাকছে না। তা বিভিন্নস্থানে দখল হয়ে আছে। এই পরিস্থিতি দুর্ঘটনার জন্য বেশ
সহায়ক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় বর্তমানে প্রতি কিলোমিটারে ২৪৭ টিরবেশি গাড়ি চলে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আওতাধীন ২২৩.৩০ কিলোমিটার রাস্তায় আনুমানিক গাড়ি চলে ৫ লক্ষাধিক। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কে অবৈধ স্থাপনা, বাজার, বিকল্প রাস্তার ব্যবহার না করে যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুড়ির কারণে ঢাকায় দুর্ঘটনা ঘটে।