রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির কথোপকথনসহ মেসেজ আদান-প্রদানের তথ্য উদ্ধার করেছে পুলিশ বরগুনায় । মূলত প্রযুক্তির কারণেই রিফাত হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হয়েছেন নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি।
বরগুনা জেলা পুলিশের এক সদস্য জানান, নয়ন বন্ডের মায়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করা মোবাইল ফোন নম্বরটি গোপনে ব্যবহার করতেন মিন্নি। নয়ন বন্ডই এই সিমটি মিন্নিকে দিয়েছিলেন। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাসহ নানা কারণে গোপনীয়তা বজায় রাখতে ওই সিমটি গোপনে ব্যবহার করতেন মিন্নি। এছাড়া আরও কয়েকটি নম্বর দিয়েও নয়নের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের দিন সকাল ৯টা ৮ মিনিটে এই নম্বর দিয়েই নয়ন বন্ডকে কল করে ৬ সেকেন্ড কথা বলেন মিন্নি। এরপর সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটে আবারও ওই নম্বরটি দিয়ে নয়ন বন্ডকে কল দেন। এ সময় ৩৫ সেকেন্ড কথা হয়।
৯টা ৫৮ মিনিটে নয়ন বন্ড মিন্নির কাছে থাকা ওই নম্বরটিতে কল দেন। এ সময় তাদের কথা হয় ৪০ সেকেন্ড। এরপর সকাল সোয়া ১০টার দিকে কলেজের সামনেই রিফাত শরীফের ওপর হামলা করে বন্ড বাহিনী।
হামলার পর বেলা ১১টা ৩১ মিনিটে নয়ন বন্ড মিন্নিকে একটি এসএমএস পাঠিয়েছিলেন। এরপর বিকেল ৩টার সময় কল দিয়ে মিন্নির সঙ্গে এক মিনিট ২০ সেকেন্ড কথা বলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, তদন্তের জন্য মিন্নি ও নয়ন বন্ডের ব্যবহৃত নম্বরের কললিস্ট ও এসএমএস কন্টেন্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, রিফাত শরীফ মারা যাওয়ার পর নয়ন বন্ড মিন্নির কাছে একটি এসএমএস পাঠিয়েছিলেন। বিকেল ৪টার কিছু সময় আগে পাঠানো ওই এসএমএসটিতে লেখা ছিল, ‘আমারে আমার বাপেই জন্ম দেছে।’
মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নেয়া ওই পুলিশ সদস্য আরও বলেন, নয়ন বন্ডের এমন এসএমএস পাঠানোর রহস্য উদঘাটনে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমরা মিন্নির সঙ্গে কথা বলেছি। তখন মিন্নি এ বিষয়ে আমাদের বলেছেন। মিন্নির বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, রিফাত শরীফকে মারার পরিকল্পনার সময় মিন্নি নয়ন বন্ডকে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি রিফাত শরীফকে মারতে পার, তাহলে বুঝব তোমারে তোমার বাপেই জন্ম দিছে।’
মূলত মিন্নির এমন কথার উত্তর দিতেই রিফাতের মৃত্যুর পর নয়ন বন্ড মিন্নিকে ওই এসএমএসটি পাঠিয়েছিলেন। এ বিষয়টি আদালতে বলবেন বলে পুলিশকে জানালেও স্বীকারোক্তি দেয়ার সময় তা লুকিয়ে যান মিন্নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিন্নি ও নয়ন বন্ডের বিয়ের এক সাক্ষী বলেন, নয়ন বন্ডের মায়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করা মোবাইল নম্বরটি এক সময় নয়ন বন্ড নিজেও ব্যবহার করতেন। পরে ওই নম্বরটি পরিবর্তন করেন নয়ন বন্ড। মিন্নি মাদকাসক্ত ছিল। এ কারণেই সে নয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতো। আর এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতো নয়ন বন্ড। রিফাত শরীফের মাধ্যমেই মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের পরিচয় হয়। নয়ন বন্ড ও মিন্নি উভয়ই মাদকসেবী হওয়ায় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি।
এদিকে, বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত,
বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং হাইকোর্টেও মিন্নির জামিন আবেদনের ওপর
শুনানি হয়েছে। কিন্তু কোনো আদালতই জামিন মঞ্জুর করেননি মিন্নির। প্রতিটি
জামিন শুনানিতেই বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উপস্থাপন করেছেন মিন্নি ও নয়ন
বন্ডের কথোপকথন ও মেসেজ আদান-প্রদান সংক্রান্ত কললিস্ট ও হত্যাকাণ্ডের সময়
সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ।
এছাড়াও এ হত্যা মামলার দুই নম্বর
আসামি রিফাত ফরাজি, তিন নম্বর আসামি রিশান ফরাজি, ছয় নম্বর আসামি রাব্বি
আকন এবং ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় হত্যাকাণ্ডে মিন্নির সম্পৃক্ততার বিষয়টি
স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া মিন্নি নিজেও রিফাত
হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বরগুনা আদালতে মিন্নির আইনজীবী এডভোকেট গোলাম মোস্তাফা কাদের বলেন, গত ৩০শে জুলাই জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মিন্নির জামিন শুনানির সময় বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ মিন্নি ও নয়ন বন্ডের কথোপকথন ও মেসেজ আদান-প্রদান সংক্রান্ত কললিস্ট উপস্থাপন করেছিল এবং আদালত তা আমলেও নিয়েছিলেন।
ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মো. রেজাউল করিম বলেন, হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চেও বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষ সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ মিন্নি ও নয়ন বন্ডের কথোপকথন ও মেসেজ আদান-প্রদান সংক্রান্ত কললিস্ট উপস্থাপন করেছিল। শুনানির সময় যেসব গ্রাউন্ডে আসামিপক্ষ মিন্নির জামিন মঞ্জুরের জন্য আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করে, সেসব গ্রাউন্ডের বিপরীতে পর্যাপ্ত প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি।
এদিকে রিফাত হত্যা মামলায় আগামী ২২শে আগস্ট আসামিদের হাজির করার ও পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।
মামলার
তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা থানার ওসি (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির জানান,
অভিযোগপত্র জমা দেয়ার জন্য বুধবার (১৪ আগস্ট) দিন ধার্য ছিল। প্রতিবেদন
তৈরি করতে না পারায় তিনি আদালতে তা দাখিল করতে পারেননি। তবে পরবর্তী তারিখ
২২শে আগস্ট দাখিল করতে পারবেন বলে জানান।
মিন্নির পক্ষের আইনজীবী
এডভোকেট মাহাবুবুল বারী আসলাম জানিয়েছেন, আদালতে তদন্ত কর্মকর্তার
প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল বুধবার। রিফাত হত্যার সঙ্গে জড়িত আসামিদের নাম
উল্লেখ করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দাখিল করলে ও বিচারক তা গ্রহণ
করলে সেটিই চার্জশিট হিসেবে গণ্য হবে।
রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরা হচ্ছেন- রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী, চন্দন সরকার, রাব্বি আকন, হাসান, অলি, টিকটক হৃদয়, সাগর, কামরুল ইসলাম সাইমুন, আরিয়ান শ্রাবন, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, তানভীর, নাজমুল হাসান, রাতুল সিকদার ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। এদের মধ্যে রাতুল শিকদারের বয়স কম হওয়ায় সে যশোরে শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে রয়েছেন।
মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ নম্বর আসামি মুসা বন্ড, সাত নম্বর আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, আট নম্বর আসামি রায়হান ও ১০ নম্বর আসামি রিফাত হাওলাদারকে এখনো পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। প্রধান আসামি নয়ন বন্ড গত ২রা জুলাই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ২৬শে জুন সকালে প্রকাশ্যে বরগুনা সরকারি কলেজ গেটের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে আহত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশাল নেয়ার পর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন।