বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে চারদিকে অগণিত সেনারা । গলির মুখে, রাস্তার বাঁকে অল্প ব্যবধানের দূরত্বে সশস্ত্র সেনাদের চেকপোস্ট। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাই কঠিন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয়েছে কাশ্মীরে। পুরোপুরি অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কেটেছে সেখানকার মানুষদের। ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা বন্ধ থাকায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগও সম্ভব হয়নি। এমনটাই জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি ও এএফপিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
কাশ্মীরের শ্রীনগরে ঈদের দিনের বর্ণনায় গার্ডিয়ান বলেছে, ঈদের কয়েকদিন আগেই নিরাপত্তা কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল। তবে ঈদের আগ দিয়ে তা ফের কঠোর করে দেয়া হয়। স্থানীয় মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায়ের অনুমতি পেয়েছিলেন বাসিন্দারা। তবে শর্ত বেঁধে দেয়া হয় যে, কেউ দুইজনের বেশি একসঙ্গে হেঁটে যেতে পারবেন না। পুরো বছরের মধ্যে ঈদুল আজহা হচ্ছে কাশ্মীরিদের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার জন্য বছরের এই সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
‘ঈদের পর আমরা ৩৭০ ফিরিয়ে আনবো’
কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, বিক্ষোভ এড়াতেই এমন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করার পর শ্রীনগরের রাস্তায় নেমে আসে প্রায় ১০ হাজার বিক্ষোভকারী। তাদের দমাতে উন্মুক্তভাবে গুলি ছুড়েছে ভারতীয় সেনারা। তবে কেন্দ্রীয় সরকার এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানায়, সর্বোচ্চ ২০ জন মানুষ বিক্ষোভ করতে নেমেছিল। যদিও টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রচারিত ফুটেজে বিশাল সংখ্যার মানুষ দেখা গিয়েছিল। উল্লেখ্য, ৩৭০ ধারা রদ হওয়ায় সংবিধান কর্তৃক দেয়া বিশেষ মর্যাদা হারিয়েছে কাশ্মীর। এই ধারার অধীনে যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যতীত অন্যান্য সকল বিষয়ে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটির। এ ছাড়া, স্থানীয়দের ছাড়া বাইরের কেউ সেখান থেকে জমি কিনতে পারতো না, চাকরির আবেদনও করতে পারতো না। কেন্দ্রীয় সরকার কেবল কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারই কেড়ে নেয়নি। রাজ্যটিকে আলাদা দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার ঘোষণাও দিয়েছে।
৩৭০ ধারা রদ করার পরপরই পুরো রাজ্যে আরোপ করা হয় কারফিউ। এর আগেই মোতায়েন করা হয়েছিল আড়াই লাখ সেনা। বন্ধ করে দেয়া হয় সকল ধরনের টেলিযোগাযোগ। বহির্বিশ্ব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় রাজ্যটিকে। ঈদের আগ দিয়ে কিছুটা শিথিল করা হয় কারফিউ। শ্রীনগর থেকে বিবিসি’র এক প্রতিবেদক জানান, শনিবার কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল। শ্রীনগরে খুলেছিল কিছু দোকানপাট। বেশকিছু মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছিলেন, শুধু ঈদের উপহারই নয়- নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেও। কোরবানির পশু বেচতে শ্রীনগরের একটি রাস্তার মোড়ে এসেছিলেন কয়েকজন বিক্রেতা। তবে হতাশ হতে হয়েছে তাদের। কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে এমন এক বিক্রেতা জানান, এটি কোনো ঈদ নয়, এটি এবার শোক। গত দুইদিন আমরা তেমন কিছু করিনি। ঈদের পর আমরা ৩৭০ ফিরিয়ে আনবো। এটা কাশ্মীর। এটা আমাদের ভূমি। যখনই মুসলমানদের কোনো উৎসব আসে, তখনই কোনো না কোনো গণ্ডগোল তৈরি হয়। ভারতকে বুঝতে হবে- এটা আমাদের জন্য একটি বড়দিন। এটি আত্মত্যাগের দিন, সুতরাং আত্মত্যাগ করবো। দু’দিন পর দেখবেন, এখানে কী হয়।
‘আমাদের অন্তরে আগুন জ্বলছে’
ঈদের
আগে কাশ্মীরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে গ্রামের বহু খামারি এবার শহরে
গিয়ে কোরবানির পশু বিক্রি করতে পারছেন না। তারা বিরাট সংকটে পড়েছেন।
শনিবার কারফিউ শিথিল করার পর কিছু ফেরিওয়ালা ঠেলাগাড়িতে ফল, সবজি সাজিয়ে
ফেরি করতে বেরিয়েছিলেন। তারাও তেমন কিছু বিক্রি করতে পারেননি। বিবিসি’র
প্রতিবেদক জানান, শুক্রবার একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিক্ষোভের ছবি
প্রকাশ হওয়ায় রোববার থেকে ফের কঠোর করা হয়েছে নিরাপত্তা।
এদিকে,
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, তারা শুক্রবার কাশ্মীরে বিক্ষোভ দেখেছে। পুলিশের
গুলিতে আহত হওয়া তিনজন ব্যক্তিকে দেখেছে। তবে মোট কতসংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে
সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি তারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আহতদের সংখ্যা না
জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানায় বৃটিশ গণমাধ্যমটি। তবে জনগণের মনে
রোষ দানা বাঁধছে বলে জানায় পত্রিকাটি। ৭৫ বছর বয়সী কাশ্মীরি হাবিবুল্লাহ ভট
সোমবার অসুস্থ শরীর নিয়েও ঈদের নামাজ পড়তে যান। তিনি বার্তা সংস্থা এপিকে
বলেন, আমাদের অন্তরে আগুন জ্বলছে। ভারত আমাদের কালোযুগে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু খোদা আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের বিদ্রোহ জয়ী হবেই।
এদিকে,
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সোমবার দাবি করেন, স্থানীয়
মসজিদগুলোয় শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ পড়তে দেয়া হয়েছে। কোনো বিক্ষোভের ঘটনা
ঘটেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাশ্মীরিরা নামাজ পড়তে যাচ্ছে এমন
ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, তবে সেগুলো কোথায় তোলা হয়েছে তা বলা হয়নি।
পুলিশ বাহিনীতেও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
ঈদের
দিন সরকারি একটি ল্যান্ডফোন খুলে দেয়া হয়েছিল জনগণের জন্য। তাতে দেখা যায়
বিশাল লম্বা লাইন। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে
আলাপ করেছেন। ছোট্ট একটি কক্ষের ভেতর ফোনটি রাখা হয়েছিল। ওই কক্ষ থেকে এক
বালিকা তার বাবাকে বলতে শোনা যায়- আমার উপহার লাগবে না, তুমি ফিরে আসলেই
হবে। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তার মা কাঁদতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের
অনেকেও কাঁদতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় এক পুলিশ কর্মী তাদের কাঁদতে নিষেধ
করেন। বলেন, সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ দেখা গেছে সেখানকার স্থানীয় পুলিশদের মধ্যেও। সেনা মোতায়েনের পরপর তাদের সাহায্য করার নির্দেশ দেয়া হয় স্থানীয় পুলিশকর্মীদের। তবে কেড়ে নেয়া হয় তাদের অস্ত্র। এমন এক পুলিশকর্মী জানান, আমাদের হয়রানি করা হয়েছে। আমরা তাদের জন্য রক্ত দিয়েছি আর তারা আমাদের সকলের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। অপর এক পুলিশকর্মী জানান, যদি বিক্ষোভ হয় তাহলে তিনি তা থামানোর জন্য কিছুই করবেন না। তিনি বলেন, এখন শিশুদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তারা (সেনা) সব বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।