ভারত সরকার রাতারাতি কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর পাঁচদিন কেটে গেছে। শুক্রবারেও গোটা রাজ্য জুড়ে বহাল ছিলো কারফিউ। স্তব্ধ হয়ে পরেছে জনজীবন। রাজধানী শ্রীনগরের পথে পথে শুধু সেনাটহল আর তল্লাসি, বন্ধ হয়ে রয়েছে দোকানপাট। এমনকি শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের জন্য শুক্রবার মসজিদে যেতে বোধা দেয়া হয়েছে কাশ্মীরের মুসল্লিদের।

তবে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই প্রদেশটি তাদের সংবিধানিক স্বীকৃতি হারানোর ঘটনায় যে ক্ষোভে ফুঁসছে তা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। তবে এটা শুধুই অন্য রাজ্যের লোককে কাশ্মীরে এসে জমি-বাড়ি কিনতে দেওয়ার বিরোধিতার মতো ইস্যু নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে কাশ্মীরের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর সেখানকার জনগণের এক বুক ফাটা কান্নার আবেগ।

মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর কাশ্মীরের লোকজন এখন আর ভারতকে বিশ্বাস করছে না। কেননা বিশ্বাসের সেই সেতুটা যে ভারতই ভেঙে দিয়েছে। তাই তাদের কাছে এই হিন্দুবাদী সরকার এখন ‘মুনাফেক বা বিশ্বাসঘাতক’হিসাবেই পরিচিত।

রাজপুরার ব্যবসায়ী ইরফান জাভিদ মনে করেন, ‘ভারতই যেহেতু সেই সেতুটা ভেঙে দিয়েছে – তাই এখন কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের, তা সে বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই হোন বা মূল ধারার ভারতপন্থী রাজনীতিবিদই হউক, তাদের এখন খুব ভেবেচিন্তে স্থির করতে হবে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কাদের সাথে হবে।’

ইরফান জাভিদ আরো বলেন, ‘৩৭০ যে শুধু কাশ্মীরের জন্য ছিল তা কিন্তু নয়। জম্মুর হিন্দুরা বা লাদাখের বৌদ্ধরাও এই স্বীকৃতি বা অধিকার ভোগ করে আসছেন গত সত্তর বছর ধরে। তা ছাড়া বিশেষ মর্যাদা তো ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও আছে। তবে কেবল মুসলিম-গরিষ্ঠ প্রদেশ বলেই কাশ্মীরের এই অধিকার কেড়ে নেওয়া হল।’

কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুদাসসর নাজির মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘দেশভাগের আগে কাশ্মীর কিন্তু স্বতন্ত্র একটি দেশ ছিল, স্বাধীন মুলুক ছিল। সাতচল্লিশের পর সেই দেশকেই ভারত আর পাকিস্তান আধাআধি ভাগ করে নিল। আর ভারত যে শর্তে কাশ্মীরকে নিয়েছিল তারই ভিত্তিছিল এই ৩৭০। তাহলে আমাকেএখন বলুন সেই আমলের ভারতীয় নেতারা কি দেশদ্রোহী ছিলেন?’

তিনি বিবিসি সাংবাদিককে আরো বলেন, ‘আর একটা কথা মনে রাখবেন, কাশ্মীরিরা নিজের রুটি ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু তারা নিজের জমি, নিজের মা-কে অন্যের সঙ্গে ভাগ করতে চাইবে না।’

বাদামিবাগ এলাকা থেকে একটু এগিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছতেই বিবিসির সাংবাদিক দেখে এগিয়ে আসেন ট্যাক্সি ইউনিয়নের জনাকয়েক নেতা। তাদের প্রেসিডেন্ট গওহর বাট কাশ্মীরের বিখ্যাত কেওয়া চা খাইয়ে তাকে বোঝাতে থাকেন, ‘আমরা যেখানে বসে আছি তার ঠিক পেছনের বিল্ডিংটাই কাশ্মীরে জাতিসংঘের মনিটরিংয়ের কার্যালয়। এবার আপনি আমাকে বলুন, কাশ্মীর যদি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই হয়, তাহলে এই জাতিসংঘের ভবনটা এখানে কী করছে? সোজা কথা হল, জাতিসংঘের দৃষ্টিতেও এটা একটা বিতর্কিত ভূখন্ড!’

তার ভাষায়, ‘এটা না ভারতের, না পাকিস্তানের, না চীনের। আমাদের তো এরা গোলাম বানিয়ে রেখেছে।’আর গওহর বাটের এই কথায় সমস্বরে গলা মেলান ভিড় করে আসা জনতা।

আসলে গত সত্তর বছরেও এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যূত হয়নি এখানকার লোকজন। সুযোগ পেলেই তারা বিদ্রোহ করেছে, ভারতের পতাকা পুড়িয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের এভাবে অবদমিত করে রাখা যাবে না। এই কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্পৃহাকে বরাবরই অবমূল্যায়ণ করেছে ভারত। রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধানের বদলে বারবারই ভরসা করেছে বন্দুকের নলের ওপর। কখনও এসব স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ কখনও ‘জঙ্গি’বলে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু বন্দুক হাতে তুলে নিয়ে ভারতীয় সেনাদের মোকাবেলা করা এসব যোদ্ধারা কাশ্মীরি জনতার কাছে বরাবরই বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাইতো সেনাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর তারা পায় শহীদের মর্যাদা। যে জাতির কিশোর-তরুণ-যুবক শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এভাবে রক্ত দিতে পারে সামান্য কলমের কালিতে তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া কী এতই সোজা!

এই সত্যটা জানে মোদি সরকারও। তাই বুঝি উপত্যকায় লাখ লাখ সেনারা সমাবেশ করে কার্যত নিজভূমে বন্দি করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরিদের। এই ১৪৪ ধারা বা সেনা প্রহরার কড়াকড়ি উঠে গেলে ভূস্বর্গে কী বিস্ফোরণ হয় সেটাই দেখার বিষয়। সেনাদের কব্জায় থাকা আপাতঃদৃষ্টিতে শান্ত কাশ্মীরকে দেখে তা অনুমানও করা যাবে না। তাই বুঝি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই কাশ্মীরকে একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি সঙ্গে তুলনা করছেন, যার বিস্ফোরণের জন্য কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031