প্রতিবছরের মতো এবারও পশুরহাটকে টার্গেট করে সক্রিয় হচ্ছে জাল নোট চক্র। এসব চক্র তৈরি করছে বিভিন্ন মানের জাল নোট। এর বাইরে কিছু চক্র ভারতীয় রুপিও তৈরি করছে। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন টাকার পাশাপাশি এসব জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হবে। জাল নোট তৈরিরে জড়িত রয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক চক্র। গোয়েন্দাসূত্র বলছে, নতুন পুরাতন মিলিয়ে জালনোট চক্রের সঙ্গে সারাদেশে শতাধিক চক্র জড়িত রয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ২০ থেকে ২৫টি চক্র রয়েছে। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল।
জামিনে বের হয়ে তারা একই কাজে লিপ্ত হয়েছে।
এবারের কোরবানি ঈদে জাল নোট
চক্রের সদস্যরা অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ
করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পশুর হাটে যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
তৎপর না থাকে তবে এই সুযোগে জাল টাকা চক্র আসল টাকার ভেতরে জাল নোট ঢুকিয়ে
ছড়িয়ে দেবে। এতে করে পশু বিক্রেতাসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা লোকসানের সন্মুখিন
হবে।
ওদিকে জাল টাকা চক্রকে ঠেকাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আগাম
তৎপরতা শুরু করেছেন। কারন বিগত বছরগুলোতে জালনোট চক্রের অপতৎপরতা পশুরহাটের
বিক্রেতাদের জন্য সুখকর ছিল না। যদিও জাল টাকা শনাক্ত ও চক্রকে ধরার জন্য
নানা উদ্যেগ নেয়া হয়েছিল। তবুও এসব চক্র নানা কৌশলে তাদের বানিজ্য করেছে।
তাই আগে থেকেই গোয়েন্দারা অভিযান পরিচালনা করছেন।
ইতিমধ্যে ঢাকা
মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার টিম এরকম একটি
জাল নোট চক্রের কয়েকজন সদস্যকে আটক করেছে। এই চক্রটি ঢাকার রামপুরায়
পলাশবাগ মোড়ের একটি ভবনের আট তলার ফ্ল্যাটে বসে জাল রুপী তৈরি করে আসছিল।
গোপণ সংবাদের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশের ওই টিম ৫০০ ও ২০০০ হাজারে মোট ২১
লাখ রুপি উদ্ধার করেছে। এছাড়া জাল রুপি তৈরির কাজে ১টি প্রিন্টার, ১টি
ল্যাপটপ, ১টি লেমিনেটিং মেশিন, রুপি তৈরির কাগজ, প্রিন্টারে ব্যবহৃত কালি,
সিকিউরিটি সিল সংবলিত স্ক্রিন বোর্ড, গাম ও ফয়েল পেপার উদ্ধার করা হয়েছে।
আটক
এই চক্রটি জালনোট তৈরি করে ভারতে পাচার করার চেষ্টা করছিল। পাশপাশি জাল
রুপী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরসহ সীমান্তবর্তী অন্য এলাকার ব্যবসায়ীদের সরবরাহ
করত তারা। রামপুরার কারখানায় নিঁখুতভাবে রুপি তৈরি করত আবদুর রহিম ও রনি ডি
কস্তা।
একইভাবে গত ঈদের সময় ঢাকার কামরাঙ্গীচর ও চক বাজার এলাকায়
অভিযান চালিয়ে ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার জাল টাকা ও তৈরির সরঞ্জামসহ একটি চক্রের তিন
সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। আটকের পর চক্রের সদস্য সবুজ,
জামাল উদ্দিন ও বাবু গোয়েন্দাদের জানিয়েছিল ঈদকে ঘিরেই তারা জাল নোট তৈরি
করে। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অন্যান্য স্থানে সরবরাহ করত।
গোয়েন্দাসূত্র
জানিয়েছে, প্রতি বছর কোরবানি ঈদে ভারত থেকে চোরাই পথে গরু নিয়ে আসেন কিছু
ব্যবসায়ী। এছাড়াও আনা হয় বিভিন্ন ধরনের পোশাক ও কসমেটিক। এসব পণ্য আনার
ক্ষেত্রে অনেক সময় জাল নোটের ব্যবহার করা হয়। এমনকি দেশের ভেতরে পশুরহাটে
গরু ক্রয়-বিক্রয় ও শপিং মল গুলোতে জাল নোটের সরবরাহ বেড়ে যায়।
সূত্রমতে, দেখতে অবিকল নোটের মতই এসব জাল নোট। খালি চোখে এবং ভালভাবে না দেখলে জাল নোট চেনার কোন উপায় নেই। সূত্রমতে জাল নোট চক্রের সদস্যরা বড় নোট তৈরিতেই আগ্রহ দেখায়। ১ হাজার টাকা মূল্যর ১ লাখ টাকা তৈরি করতে তাদের খরচ হয় সাত থেকে ১০ হাজার টাকা। এই এক লাখ টাকা আবার বড় শহরের পাইকারি ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। তারা আবার সেই টাকা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। তাদের হাত বদলে এই টাকা প্রান্তিক লেভেলের ব্যবসায়ীদের কাছে যায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। তারা সেই এক লাখ টাকা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে পুরো এক লাখই আদায় করে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, জাল নোট চক্রের তৎপরতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নেয়া। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, জাল টাকা প্রতিরোধে আইন সংশোধনের চেষ্টা চলছে।
এদিকে জাল নোট তৈরির সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু চক্রের সদস্যদের গোয়েন্দারা নজরদারিতে রেখেছেন। তারা হলেন, রফিক, সালাউদ্দিন, রাসেল, সহিদুল, জুয়েল, জাকির, রানা, রাজন, শিকদার, খোকন, মনির, সোহরাব, জসিম, লাবনী, ওসমান, কবির, জহিরুল, আলম, হোসেন, নজরুল, আলআমিন, ফাতেমা, সাইফুল, মনির, পারভেজ, রহিম, মনিরুল, হাসান, কামাল, রুজিনা, রাশেদা ও জিহানসহ আরও অনেকে। এসব সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে জাল নোট তৈরি করার অভিযোগে গ্রেপ্তারও হয়েছিল। কিন্তু চক্রের মূলহোতারা ছিল অধরা। হোতারাই টাকা খরচ করে জামিনে মুক্ত করে এনে আবার কাজে লাগিয়ে দেয়।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সারাদেশের পশুরহাট, শপিং মলে পোশাকে-সাদা পোশাকে পুলিশ, গোয়েন্দা ও র্যাব সদস্যরা কাজ করবেন। জাল টাকা শনাক্ত করার জন্য মেশিন থাকবে। বিগত বছরগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদের এক থেকে দুই দিন আগে চক্রের সদস্যরা বেশি জাল নোট ছাড়ে। কারণ ওই সময় বিক্রি ভাল হয় এবং টাকার লেনদের বেশি হয়। প্রতিটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই ব্যস্ততা থাকে। ভালভাবে টাকা যাচাই বাচাই করার সময়ও থাকে না। আর এই সুযোগেই জাল নোট চলে আসে। বিশেষকরে নতুন টাকার সঙ্গে জাল নোট ঢুকানো হয়। চেনার কোন উপায়ই থাকে না।
আনোয়ার হোসেন নামের এক পশু ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের ঈদে ব্যাংকে দুই লাখ টাকা জমা দিতে গিয়ে আমার বান্ডিল থেকে চারটি পাঁচশ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছিল। কি করে এই জাল নোট বান্ডিলে ঢুকেছে টেরই পাইনি। তাই এ বছর আগে থেকেই সতর্ক আছি। মনির আলী নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ঈদে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ সুযোগেই জাল টাকা আসল টাকার ভেতরে দিয়ে ফায়দা নেয় কিছু লোক। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সময়ও জাল নাট পাওয়া যায়। তাই কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে আরও বেশি নজর দেয়া দরকার।