ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীন চট্টগ্রাম শহরকে মেগাসিটিতে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নগরপিতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন । আজ সেই দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। সত্যিকার অর্থে একটি মেগাসিটির নাগরিকরা যেসব সুবিধা ভোগ করে থাকেন চট্টগ্রাম শহরের ৬০ লক্ষ জনগণ তা ভোগ করছেন কী না সেটা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।
মেয়রের ৪ বছর পূর্তিতে এসে নিজেদের নাগরিক সেবাপ্রাপ্তি কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে তার হিসাব কষছেন নগরবাসী। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ মিলাচ্ছেন তারা। বসে নেই মেয়রও। নাগরিকদের দেয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন, নিজের সাফল্য এবং অর্জনগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরছেন নাগরিকদের কাছে। হচ্ছেন জনগণের মুখোমুখি। বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নিজের সীমাবদ্ধতার কথাও। তবে সিটি কর্পোরেশন যে অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত হয় তার মধ্যে থেকে বিগত সময়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল। এতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আ.জ. ম নাছির উদ্দীন। পরবর্তীতে ৬ মে শপথ নেন তিনি। তবে আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে সাথে সাথে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি। ওই বছরের ২৬ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
সাবেক মেয়র যা বললেন : বিগত চার বছর দায়িত্ব পালনকালে বর্তমান মেয়র নাগরিক প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র (২০১০-২০১৫) মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, ‘নগর পিতার দায়িত্ব নগরবাসীকে সেবা দেয়া। তার কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশাও বেশি। মেয়রের যারা সহযোগী তাদেরও দায়িত্ব আছে। মেয়রের মেয়াদের তো আরো কিছু সময় বাকি আছে। অবশ্য পত্রপত্রিকায় মেয়রের বক্তব্য এসেছে, সেখানে তিনি বলেছেন, জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। তিনি ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলোর ব্যাপারেও আশাবাদী বলা হচ্ছে। আমরাও আশা করবো, তিনি যেন যথাসময়ে তার প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করেন। এতে নগরবাসী উপকৃত হবেন।
বর্তমান মেয়রের উল্লেখযোগ্য সাফল্য-ব্যর্থতা আছে কী না জানতে চাইলে সাবেক এই মেয়র বলেন, বহুমুখী সেবা প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন। বিভিন্ন ওয়ার্ডে নানা প্রকল্প আছে। সেখানে কোথাও স্লো হয়েছে বা কোথাও ত্রুটি আছে। সবকিছুৃ তো আবার শতভাগ করাও সম্ভব না। সেক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়ে নগরবাসী বলতে পারবেন। নগরবাসী মূল্যায়ন করবেন। তিনি যে নগরবাসীর মুখোমুখি হচ্ছেন সেটা ভালো উদ্যোগ। তবে একটি দিক আছে, তিনি ঘন ঘন বিদেশ যান। এতে আমরা সেবা থেকে একটু বঞ্চিত তো হচ্ছিই। এখানে থাকলে সেবা আরেকটু ত্বরান্বিত হতো।
আলোচনা-সমালোচনা ছিল যেসব বিষয়ে :
সিটি মেয়রের বিগত দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেশ কিছু বিষয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। আবার সমালোচিতও হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে মেয়র ‘ঘুষ না দেয়ায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ কম পাচ্ছে’ মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন। বেশিরভাগ নগরবাসী এর প্রশংসা করেছিলেন। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে গণপূর্ত বিভাগের এক প্রকৌশলীকে ‘থাপ্পড়’ মারার অভিযোগ ওঠে মেয়রের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়েও নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।
এছাড়া আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের বিষয়ে সরকার যখন তৎপর ঠিক সেই মুহূর্তে নগরীর ‘জাতিসংঘ’ পার্ককে ঘিরে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৬ সালে। এটা নিয়েও ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা। অবশ্য পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় চসিককে সেখানে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদন দেয়। তবে মেয়র সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছিলেন পৌরকর আদায় প্রক্রিয়া নিয়ে। পৌরকর নির্ধারণে পঞ্চবার্ষিকী পুর্নমূল্যায়ন শেষে ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এরপরই ক্ষোভ প্রকাশ করেন নগরবাসী। তাদের অসন্তুষ্টির কারণ ছিল, পূর্বের ন্যায় বর্গফুটের ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করে ভাড়ার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা। এই ইস্যুতে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মাঠে নামেন নগরবাসী। এক্ষেত্রে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করে। অবশ্য এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করলেও বিভিন্ন কর্মপন্থা ঠিক করে বা বাস্তবায়ন করায় পৌরকর আদায়ের হার বেড়েছে চসিকের। সর্বশেষ বিদায়ী অর্থ বছরে (২০১৮-২০১৯) লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রায় ৪০ শতাংশ পৌরকর আদায় করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। যা পূর্বের সাত অর্থ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই আছে :
নাগরিক সেবা নিশ্চিতে গত চার বছরে সিটি মেয়রের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং কর্পোরেশনের বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই আছে। নগরকে ‘ক্লিন সিটি’তে পরিণত করার জন্য পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে সাফল্যের দাবি করেন মেয়র। এক্ষত্রে গৃহীত পদক্ষেপগুলো হচ্ছে- ডোর টু ডোর প্রকল্পের মাধ্যমে বাসা-বাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা সংগ্রহ, ডাম্পিং স্টেশন কমিয়ে আনা, দিনের পরিবর্তে রাতের বেলা ময়লা পরিবহন। তবে অভিযোগ আছে, এখনো শহরের অনেকগুলো স্পটে দিনেও ময়লা স্তূপ হয়ে থাকে। মুহাম্মদপুরসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ডোর টু ডোর কার্যক্রমের গতিও কমে এসেছে কোন কোন এলাকায়। এক্ষেত্রে মনিটরিংয়ের দাবি করেছেন বখতেয়ার আলম নামে এক বাসিন্দা।
দায়িত্বগ্রহণের প্রথম বছরে বিলবোর্ড উচ্ছেদে সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামের হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে প্রায় চার হাজার বিলবোর্ড, ইউনিপোল, মেগা সাইন শতভাগ অপসারণ করেন। এরপর থেকে আর কোন বিলবোর্ড স্থাপিত হয় নি সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন জায়গায়। হলেও তা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বিজ্ঞাপন নীতিমালা।
জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যক্রম গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল মেয়রের। নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলেন, ‘সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত খাল খনন, বোর্ড গঠন করে এর মাধ্যমে তদারকি করে খালে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার, খালের মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ করা’। দায়িত্ব গ্রহণের পর এ বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও জলাবদ্ধতা দূর হয় নি।
এ প্রসঙ্গে মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ২০১৫ সালে দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পর নভেম্বর মাসে চায়নার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তাদের সঙ্গে সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করি। এর ভিত্তিতে তারা ১১ মাস স্টাডি করে রিপোর্ট দেয় এবং তার আলোকে আমরা ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। এরমধ্যে ২০১৭ সালে সিডিএ’র প্রকল্প অনুমোদন পায়। এরপর প্রকল্প নিয়ে আমাদের অগ্রসর হওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে প্রকল্পের অনুমোদন না পেলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে সার্পোটিং কাজ থেকে বিরত ছিলাম না। ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করার কাজ করছি। নালা-নর্দমা থেকে ময়লা-আর্বজনা অপসারণ করেছি। বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননে যে প্রকল্প ছিল সেটা রিভাইস করেছি।’
মেয়রের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য :
এদিকে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগর উন্নয়নে এডিপিভুক্ত তিন হাজার ৭৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রকল্প চলমান আছে। এরমধ্যে রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্র্ট নির্মাণে ৭১৬ কোটি টাকা, নতুন খাল খননে এক হাজার ২৫৬ কোটি টাকা, বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ১২০ কোটি টাকা, সড়কের উন্নয়ন ও আধুনিক যান সংগ্রহে ৪২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং বাস টার্মিনাল নির্মাণে এক হাজার ২৩০ কোটি টাকার প্রকল্প আছে। এছাড়া জাইকার অর্থায়নেও বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। বিএমডিএফ ফান্ডের চারটি প্রকল্প আছে ১৬০ কোটি টাকায়। ২৩১ কোটি টাকায় সেবক কলোনি নির্মাণ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় ৮৮ কোটি টাকায় আধুনিক কসাইখানা নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এছাড়া ২০৪ কোটি টাকায় নগর ভবন নির্মাণ, ২৭০ কোটি টাকায় র্স্মাট সিটি প্রকল্প, বিমানন্দর সড়ক সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রকল্প এবং পাহাড়ের ক্ষয়রোধে ৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বাস্তবায়নাধীন এবং অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে নগরবাসী এর সুফল ভোগ করবেন বলেও জানান মেয়র।