যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর
নির্যাতনের অভিযোগ করে আলোচিত প্রিয়া সাহা তার বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা
দিয়েছেন, যেখানে তিনি নিজের অবস্থানে অনড় থাকার কথা বলেছেন। প্রিয়া সাহার
দাবি, ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের নিখোঁজ হওয়ার যে তথ্য তিনি
ট্রাম্পকে দিয়েছেন, তা সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই নেওয়া। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত ওই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ২০১১ সালে
একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যা সে সময় গণমাধ্যমেও আসে।
তিনি বলেছেন, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ও
যুক্তরাষ্ট্র সরকার যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে- সেজন্যই তিনি হোয়াইট হাউজে
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহযোগিতা চেয়েছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
অভিযোগ করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। একজন সাংবাদিককে প্রিয়ার সাক্ষাৎকার
দেওয়ার একটি ভিডিও রোববার তার এনজিও শারির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়,
সেখানেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজের ব্যাখ্যাগুলো তুলে ধরেন। খবর
বিডিনিউজের।
দলিত সমপ্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শারি’র পরিচালক প্রিয়া
সাহা বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন সাংগঠনিক
সম্পাদক। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত ১৭ জুলাই তিনি হোয়াইট হাউজে যান।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের
নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান
নিখোঁজ (ডিজঅ্যাপিয়ার্ড) হয়েছেন। প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের
দেশে থাকতে চাই। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ আছে। আমার
অনুরোধ, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। তারা আমার বাড়ি
পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি। তার ওই বক্তব্যে
তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় দেশের বিভিন্ন মহলে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়,
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই’ প্রিয়া সাহা ওই ধরনের
‘বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ’ করেছেন। দেশে ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে
বলেও ঘোষণা দেন একজন মন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
শনিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই বক্তব্য দিয়ে প্রিয়া সাহা
‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ’ করেছেন। তবে রোববার তিনি জানান, প্রিয়া সাহার
ব্যাখ্যা শোনার আগে তড়িঘড়ি কোনো আইনি ব্যবস্থা না নিতে প্রধানমন্ত্রীর
নির্দেশনা পেয়েছেন তিনি।
শারির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওতে প্রিয়া সাহা বলেন, সরকারের
আদমশুমারি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দেশভাগের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যার
২৯.৭ শতাংশ ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের নাগরিক। ওই হার এখন নেমে এসেছে
৯.৭ শতাংশে। এখন দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন। সংখ্যালঘু জনসংখ্যা
যদি একই হারে বৃদ্ধি পেত, তাহলে অবশ্যই যে জনসংখ্যা আছে, এবং যে জনসংখ্যার
কথা আমি বলেছি ক্রমাগত হারিয়ে গেছে, সেই তথ্যটা মিলে যায়।
প্রিয়া সাহা বলেন, সরকারের ওই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই অধ্যাপক আবুল
বারকাত ২০১১ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে বলা
হয়েছিল, প্রতিদিন ৬৩২ জন হিন্দু দেশ ছাড়ছেন। ২০১১ সালে আমি স্যারের সাথে
সরাসরি কাজ করেছিলাম, যে কারণে আমি বিষয়টা সম্পর্কে অবহিত।
৩৭ মিলিয়ন মানুষ ‘ডিজঅ্যাপিয়ার্ড’ বলতে প্রিয়া সাহা ঠিক কী বলতে
চেয়েছেন- তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সাক্ষাৎকারে। উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের
জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের হার যদি
দেশভাগের সময়ের মতই ২৯.৭ % থাকত, তাহলে তাদের সংখ্যাটাও এখন বেশি হত। এখন
এই যে নাই, এইটা যে ক্রমাগতভাবে কমে গেছে, সেটাই আমি বোঝাতে চেয়েছি। ধর্মীয়
সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের জনসংখ্যা কেন এভাবে কমে গেল, তারা কোথায় গেল, তারা
কোথাও চলে গেছে কি না, কেউ মেরে ফেলেছে কি না- এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো
উত্তর প্রিয়া সাহা দেননি।
কীসের ভিত্তিতে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে’ এরকম বড় অভিযোগ করলেন- এমন প্রশ্নে
প্রিয়া সাহা বলেন, আমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইনি। আমার গ্রামের
বাড়ি পিরোজপুরে। সেখানটায় ২০০৪ সালে প্রায় ৪০টা (হিন্দু) পরিবার ছিলল, এখন
১৩টা পরিবার আছে। এই মানুষগুলো কোথায় গেল, কোথায় আছে, তা তো আপনাদের দেখার
কথা বা রাষ্ট্রের দেখার কথা। সেটা আমার কাছে জানতে চাইলে কেমন হবে? প্রিয়া
সাহা কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বিষয়টি তুললেন- সেই প্রশ্ন
রাখা হয়েছিল সাক্ষাৎকারে।
উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এই কথাগুলো তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা। ২০০১
সালে যখন সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর নির্বাচনোত্তর চরম নির্যাতন চলছিল ৯৪
দিন ধরে, আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। তিনি
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য সারা পৃথিবীতে ঘুরেছেন। সমস্ত
জায়গায় বক্তব্য দিয়েছেন। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার অনুসরণে আমি বলেছি।
যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো জায়গায় বলা যায়- এটা আমি তার কাছে
শিখেছি। বাংলাদেশের নেতারা সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির যে কথা বলেন, তার সঙ্গে
যে প্রিয়া সাহার বক্তব্য মিলছে না- সে বিষয়েও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল
সাক্ষাৎকারে।
উত্তরে তিনি বলেন, ২০০১ সালের পর (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়) সারা
দেশে সংখ্যালঘু সমপ্রদায় যে নৃসংশতার শিকার হয়েছিল, বর্তমানে আওয়ামী লীগ
সরকারের সময়ে তা ‘ব্যাপক হারে’ কমে এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মৌলবাদের
বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। আমেরিকাও মৌলবাদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমি এ কারণে বলেছি, মার্কিন সরকার যাতে এ বিষয়ে আমাদের
সরকারের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, সেজন্যই আমি এ কথাটা সেখানে বলেছি।