চট্টগ্রাম ২৫ মে : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ৫ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এছাড়া তারকা চিহ্নিত বেশ কিছু মামলাসহ মোট ২৩টি মামলায় ৩১ জনকে সাজা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তবে এর মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া ‘ঝিমিয়ে’ পড়েছে তা বলার কোনো অবকাশ নেই। বর্তমান সংসদ সদস্য, বিভিন্ন দলের উচ্চ-নিম্নপদস্থ নেতা-কর্মী এবং মাঠ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের তদন্ত চলছে দ্রুততার সঙ্গে। এসব তদন্ত শেষে চলতি বছরের যেকোনো সময় তারকা রাজাকারদের নাম বিচারপ্রার্থীদের জন্য ‘চমক’ হিসেবে উঠে আসবে বলে দাবি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার।
তদন্ত সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে সংস্থাটিতে ২২টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আর এ ২২ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫৭ জনকে।
ট্রাইব্যুনালে তারকা মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ময়মনসিংহের ৮ আসামির মামলা। এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য এমএ হান্নান ও তার ছেলে রফিক সাজ্জাদ, ডা. খন্দকার গোলাম সাব্বির, মিজানুর রহমান মিন্টু ও হরমুজ আলী। এছাড়া এখনো পলাতক থাকা ৩ আসামির পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।
ময়মনসিংহের এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিএনপি নেতা ড. ওসমান ফারুকের নামে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠে আসে। তার বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে বলে সূত্রটি জানায়।
অন্যদিকে এক মামলায় চট্টগ্রামের রাউজানের বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (গিকা চৌধুরী) বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এর পাশাপাশি পৃথক প্রায় ১০টি মামলায় যে ১০ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তারা হলেন- ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের আবুল ফালাহ মুহাম্মদ ফাইজুল্লাহ, নীলফামারীর সৈয়দপুরের ইজহার আহমেদ, গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরের আবদুল জলিল শেখ, কুমিল্লার খালেক মজুমদার, খুলনার আমজাদ মিনা, পটুয়াখালীর আয়নাল খাঁ, পটুয়াখালীর গলাচিপার আশ্রাব আলী খান এবং যশোরের এএসএম আমিন উদ্দিন, রাজশাহীর লাহার আলী শাহ, পটুয়াখালীর রুস্তম আলী সিকদার।
এদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় সাতক্ষীরায় আটকাবস্থায় থাকার পর যুদ্ধাপরাধীর মামলায় সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মণ্ডলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার গ্রেপ্তারকৃত দুই সহোদর রাজাকার আব্দুল আজিজ হাবুল ও রাজাকার আব্দুল মতিন এবং পলাতক আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই মিয়াসহ ৩ জনকে যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন অভিযোগে আসামি করা হয়েছে।
অপর একটি মামলার আসামি করা হয়েছে নেত্রকোনার ৫ রাজাকারকে। এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আজিজুর রহমান, রমজান আলী, আশক আলী ও মো. শাহ নেওয়াজ এবং পলাতক খলিলুর রহমান। অন্যদিকে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীর এনায়েত মোল্লাসহ ১১ জন একটি মামলার আসামি। আবার মৌলভীবাজার জেলার এক মামলার ৩ আসামি হলেন- আলাউদ্দিন চৌধুরী, লাল মিয়া এবং মো. মতিন মিয়া।
হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মো. সফি উদ্দিন, মো. জাহিদ মিয়া, মো. তাজুল ইসলাম ওরফে পোকন রাজাকার এবং মো. ছালেক মিয়া ওরফে ছায়েক মিয়াসহ ৪ জনকে এ মামলার আসামি করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলার পেকুয়ার মহসীন হায়দার চৌধুরী ও অধ্যক্ষ তাহের শওকত অন্য একটি মামলার আসামি। গ্রেপ্তার হওয়া নড়াইলের আব্দুল ওহাব ও ওমর আলী শেখ পৃথক একটি মামলার আসামি।
নেত্রকোনার একটি মামলায় ৩ আসামির মধ্যে সোহরাব ফকির ওরফে সোহরাব রাজাকার গ্রেপ্তার হলেও হেদায়েত উল্লা ওরফে আনজু ও এনায়েত উল্লাহ পলাতক আছেন।
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার দুই সহোদর আমীর হোসেন ও ফজলুল হক, নূরুল আমীন এবং আব্দুল মান্নান এ ৪ জন একটি মামলার আসামি।
তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান বলেন, ‘তদন্তাধীন মামলাগুলোর মাধ্যমে অচিরেই তারকা রাজাকারদের নাম উঠে আসবে। এ সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু অভিযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘তদন্ত সংস্থা পূর্বের মামলাগুলোর তদন্তের মত এক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই কাজ চালিয়ে যাবে। এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ‘নতুন চমক’ আসছে বলে জানিয়েছিলাম। মূলত এই ‘চমক’ এমনই যে, যেসব অপরাধীদের বিচাররের কথা কেউ ভাবতেও পারেনি আমরা তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করে বিচারপ্রার্থীদের সেই ‘চমক’ দেখাতে চাই। এসব মামলার মধ্যেও তারকা মামলাতো থাকছেই।’
ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ বলেন, ‘বিচার তার নিজ গতিতে চলছে। সংবাদমাধ্যম তারকা রাজাকারদের মামলায় যতটা গুরুত্ব দেয় মাঠ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের মামলায় ততটা গুরুত্ব দেয় না। এটা খুবই দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের (প্রসিকিউশনের) কাছে সব মামলার বিচার করাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা, তারকা রাজাকারদের মতই একাত্তরে মাঠ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীরাও ছিল নৃসংশ ও নির্মম।’