চট্টগ্রাম ২৪ মে : পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা তো নিষেধ!’ জিইসি মোড়ে ধূমপানরত এক পথচারীকে বলি।তিনি হেসে বলেন, ‘জানি তো।’‘তাহলে করছেন কেন?’
হাসি ঝুলিয়ে রেখেই তিনি বলেন, ‘সবাই খায়। তাই আমিও খাই।’ এ সময় মোড়ের ঝুপড়ি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এক পুলিশ সদস্যকে ধূমপানরত অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর মতো অনেকেই এখানে ব্যস্ত রয়েছেন ধূমপানে। কেউ কেউ সিগারেটে শেষ ‘সুখটান’ দিচ্ছেন। তাঁরা তোয়াক্কা করছেন না পাশ দিয়ে চলাচলকারী মানুষদের।
স্কুল ছুটির পরে বাস উঠতে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মা-মেয়ে। তাঁদের পেছনে লাইনে দাঁড়ানো তিন যুবক গল্প করছেন। সবার আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। ধোঁয়া গিয়ে লাগছে মা-মেয়ের চোখে-মুখে। বিরক্ত হয়ে মা কয়েকবার তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁদের। ফলে মা আঁচলে নিজের ও মেয়ের নাক ঢেকে পরোক্ষ ধোঁয়ার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। ঘটনাটি আজ ঘটেছে চকবাজার গুলজার টাওয়ারের সামনে।
চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে ধূমপানের এমন চিত্র অহরহই দেখা যায়। এতে যে কেবল ধূমপায়ী নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হন, বিষয়টি তেমন নয়। ধূমপান না করেও এর কুফল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না অধূমপায়ীরা। পরোক্ষ ধূমপায়ীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো জরিপ-২০০৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করে—যা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ধূমপান করে ২৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।
ধূমপানের হার পুরুষের মধ্যে অনেক বেশি। দেশের ২ কোটি ১২ লাখ পুরুষ ধূমপায়ী, যেখানে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা সাত লাখ। নিজে ধূমপান না করেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি নারী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। যার মধ্যে ৩০ শতাংশই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় কর্মস্থলে এবং ২১ শতাংশ জনসমাগমস্থলে।
ধূমপানের ক্ষতিকর দিকও কোনোভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে শমরিতা হাসপাতালের মেডিসিন কনসালট্যান্ট মোসতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ধূমপায়ীদের মধ্যে ক্রনিক ব্রংকাইটিস, ক্যানসার, বিশেষ করে ফুসফুস ও মুখ গহ্বরের, ব্রেইন স্ট্রোকসহ নানা রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের মধ্যে ধূমপানসংক্রান্ত কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
শুধু ধূমপানের কারণে প্রতিবছর ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় সাত হাজারের বেশি ক্ষতিকর পদার্থ আছে, যার মধ্যে ৬৯টিই ক্যানসারের জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের কারণে বিশ্বে প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ তামাকের কারণে বিশ্বে ১ কোটি মানুষ মারা যাবে প্রতিবছর! যার ৭০ লাখই ঘটবে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে।
পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। গর্ভের সন্তানও এই নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়ে। পরম নির্ভরতায় শিশুটি বাবার পাশে বসে খেলছে। আর ধূমপায়ী বাবাই কিনা শিশুটির সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হচ্ছে না বুঝেই। শিশুরা এতে হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধোঁয়ায় শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। ধূমপানকে বলা হয় মাদক গ্রহণের প্রথম ধাপ। বিড়ি-সিগারেটের মাধ্যমেই বেশির ভাগ মানুষ মাদক গ্রহণ করে। এ ছাড়া ধূমপান থেকে আগুন লাগার ঘটনার উদাহরণেরও কমতি নেই।
ধূমপান রোধে দরকার সচেতনতা। কিন্তু সচেতনতা সৃষ্টি করতে ধূমপানবিরোধী প্রচারণাও তেমন নেই। সরকার গত ১৯ মার্চ থেকে দেশের সব তামাকজাত দ্রব্যের গায়ে ৫০ শতাংশ জুড়ে রঙিন ছবি ও লেখাসংবলিত সতর্কবাণী বাধ্যতামূলক করেছে। তবে বেসরকারি সংস্থা ‘প্রজ্ঞা’র সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের তামাকজাত পণ্যের ৭৫ শতাংশে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নেই। এটা একেবারেই উচিত হচ্ছে না। সরকারের উচিত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
ধূমপান কখনোই কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। ধূমপান করা মানে ‘কিস্তিতে’ আত্মহত্যা করা। অনেকে ঠাট্টা করেই বলেন, ‘বিড়ি খাবি খা, মারা যাবি যা।’ তাই আর দেরি নয়, আজই ধূমপান ছেড়ে দিন।
জনস্বার্থে…
রিপোর্টার : আনিস মেহরাজ
এলার্ট নিউজ 24