জাতীয় বাজেট রাষ্ট্রের শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, তার উন্নয়ন নীতি-দর্শনের প্রয়োগিক প্রতিফলন। সে ক্ষেত্রে দেশের চার কোটি তরুণ যুবসমাজ সম্পৃক্ত করেই একটি সমৃদ্ধশালী মধ্য আয়ের বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। আর জেসিআই (জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যশনাল) বাংলাদেশ সেই লক্ষেই কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকে সামনে রেখে তাই কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যশনাল জেসিআই চিটাগাং এর কসমোপলিটন প্রেসিডেন্ট জসীম আহমেদ।
তিনি বলেন, তরুণ সমাজকে জনশক্তিতে রূপান্তর, ব্যবসা ও শিল্পোন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তরুণ উদ্যোক্তা ও শিল্পবান্ধব বাজেট প্রয়োজন।
জসীম আহমেদ বলেন, আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশই যুব সম্প্রদায়। বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের জনসংখ্যা প্রায় চার কোটি। এই চার কোটি তরুণ যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করেই বাংলাদেশের যে স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ, মধ্য আয়ের বাংলাদেশ, একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ তা গড়তে হবে। সেই স্বপ্ন যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে এ তরুণ যুব সমাজের প্রতিভা পরিস্ফুটনে সরকারি এবং বেসকারি যে উদ্যোগ তার সমন্বয় ঘটাতে হবে। যাদের কর্মসংস্থান হবে তারা যেন অর্থবহ কাজের সঙ্গে জড়িত হয় এবং নিজেদের বিকাশের সুযোগ পায়।
তিনি এই বিপুল পরিমাণ তরুণ যুব সমাজকে ব্যবসায়িক কাজে উৎসাহিত করার জন্য কয়েকটি দাবি উপস্থাপন করেন-
১। ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি উদ্যোক্তা চিহ্নিতকরণে পৃথক নীতিমালা করা।
২। তরুণ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান করা।
৩। অব্যবহৃত শিল্প প্লট (পাঁচ বছরের বেশি অব্যবহৃত) তরুণ উদ্যোক্তাদের মাঝে সহজ শর্তে উপর্যুক্ত ভাড়া বা হস্তান্তরে মাধ্যমে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।
৪। সরকারিভাবে সব উন্নয়নশীল শিল্প এলাকায় তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।
৫। সব অনাবাদি কৃষি জমি (তিন বছরের অধিক অনাবাদিকৃত) তরুণ উদ্যোক্তাদের মাঝে সহজ শর্তে উপর্যুক্ত ভাড়া বা হস্তান্তরে মাধ্যমে ব্যবহারে ব্যবস্থা করা।
৬। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ আইন যুগপযোগী করা এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ।
৭। সরকারিভাবে শিল্পক্ষেত্র উৎসাহী তরুণ উদ্যোক্তাদেরকে প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক জ্ঞান অর্জনের জন্য সরকারি অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৮। একজন তরুণ যাতে সহজে এবং কোনো সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে তার ব্যবসায়িক সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি একটি নির্দিষ্ট স্থান (ওয়ান স্টপ সলিউশন) থেকে সম্পন্ন করতে পারে।
এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন যে, দ্রুতগতির শিল্পায়ন বাদ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। আর এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের বর্তমান ঋণব্যবস্থা সেবা বা ট্রেডিং খাতের জন্য উপযুক্ত হলেও শিল্পায়নের জন্য উপযুক্ত নয়। আর এর জন্য উদ্যোক্তারা নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের পর জুতাশিল্প হতে পারে পরবর্তী সম্ভাবনাময় শিল্প। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকার জুতাশিল্পকে পৃথকভাবে চিন্তা না করে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করছে। চামড়া ছাড়া ও জুতা প্রস্তুত হতে পারে কৃত্রিম চামড়া, সিন্থেটিক, কাপড়, প্লাস্টিক ও পাট দিয়ে। সমগ্র বিশ্বের ২৫% জুতা প্রস্তুত হয় চামড়া দিয়ে আর ৭৫% জুতা প্রস্তুত হয় অন্যান্য সামগ্রি দিয়ে। তাই জুতাশিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করার জন্য সরকারিভাবে সব জুতা রপ্তানিতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। বর্তমানে সরকারি এই প্রণোদনা শুধু চামড়াজাত জুতার জন্য বহাল রয়েছে। আমাদের এই বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের জন্য পোশাক শিল্পের পর জুতাশিল্প ছাড়া সম্ভব নয়।
আমদানি রপ্তানি গতিশীলতা জন্য চট্রগ্রাম বন্দরে আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমদানিনির্ভর পণ্য চিহ্নিত করে তার শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারি সহযোগিতা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। আমদানি শুল্ক মূল্যসংযোজন কর ও আয়করসহ একটি সুষম কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই শিল্পকে প্রসারিত এবং দৃঢ় অবস্থান তৈরি নিশ্চয়তা প্রদান করা।
যাতায়াতব্যবস্থা প্রসঙ্গে জুনিয়র চেম্বার এই নেতা বলেন, যাতায়াতের চাহিদা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিচায়ক। যাতায়াতের চাহিদা যেখানে যত বেশি, সে-ই অর্থনীতি ততই গতিশীল। কিন্তু দেখা যায় ঢাকা শহরের পাশাপাশি চট্রগ্রামেও যানজটে নগরবাসীর নাকাল অবস্থা। ভবিষ্যতে যানজট কমাতে হলে রাস্তার দৈর্ঘ্য আরও বাড়াতে হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। সে সঙ্গে প্রয়োজন আরও ফ্লাইওভার, মেট্রো বা মনোরেল স্টেশন। যানজট সহনীয় ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব। আসছে বাজেটে এই ব্যাপারে জোর গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও বেশি উত্তরোত্তর সাফল্য বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সরকার সেটি অনুধাবন করেই চট্রগ্রাম ও বৃহত্তম চট্রগ্রামকে ঘিরে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকার সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এক্সপ্রেস রেলওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মিরসরাই ও আনোয়ারায় স্পেশাল ইকোনমিক জোন, মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। আরও উন্নয়নে আসছে বাজেটেও চট্টগ্রামের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর আয়করের মাত্রা না বাড়িয়ে বরং আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিধি বৃদ্ধিকরণে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর মাত্রা আরও সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জোর দাবি করেন তিনি।
এছাড়াও ব্যবসাবান্ধব এবং গণমুখী বাজেট প্রত্যাশা করে জুনিয়র চেম্বার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, জাতীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ়করণে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও আয়করসহ একটি সুষম শুল্কায়ন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করে শিল্পায়নের মাধ্যমে যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র দূরীকরণে বাজেট যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবসাবান্ধব বাজেট করা উচিত তিনি মনে করেন।