স্কুলছাত্রী আরজু মনি গত ২০শে এপ্রিল গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের শরীফ পাড়ার সৌদি প্রবাসী নিজাম উদ্দিন শরীফের মেয়ে । পুলিশ জানায়, দশম শেণীর ছাত্রী আরজু মনি তার শোবার ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে সে। তবে এটি শুধুই একটি আত্মহত্যা নয়। এর পেছনে রয়েছে- প্রেম-বিচ্ছেদ, মান-অভিমান, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের এক জটিল অঙ্ক। রয়েছে কিশোরী মনের অব্যক্ত আবেগ।

পুলিশ বলছে, স্কুলছাত্রী আরজু মনি পালিয়ে গিয়ে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে করে এলাকার রাহাত নামে এক যুবকের সঙ্গে। পরে তাদের আবারও বিয়ে দেয়া হবে- এমন আশ^াসে ফিরে আসে তারা। কিন্তু ফিরে আসার পরই মত পাল্টায় আরজুর পরিবার।

যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় আরজু নিজেও। তার মা রাহাতকে জানিয়ে দেন, তার মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দু’চার কথা শুনিয়েও দেয় রাহাত।

ঘটনার দিনে আরজুকে তার মা ঘরে আটকে রেখে বাইরে যান। ফিরে এসে দেখেন মেয়ের লাশ ঝুলছে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে। অনেকে এ ঘটনাকে বাড়াবাড়ি বলছেন। তবে আরজুর মা বলছেন, ভিন্ন কথা। তিনি বলছেন, তার মেয়ে নিজ হাতে ৫ পৃষ্টার একটি চিরকুট লিখে গেছে। তাতেই উল্লেখ আছে, কে তার মৃত্যুর জন্য দায়ি।

আরজু মনির মা লতিফা বেগম জানান, সে স্কুলে যাওয়া-আসার সময় গোপীনাথপুর গ্রামের শরীফপাড়ার রেজাউল শরীফের বখাটে ছেলে রাহাত শরীফ ও তার বন্ধুবান্ধব বেশকিছু দিন ধরে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। শুধু তাই নয়, স্কুলে যাওয়া আসার সময় তারা  মেয়ের পথরোধ করে নানান প্রকার বাজে কথাও বলতো। ওদের ভয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মেয়েকে ওরা বাজে ইঙ্গিত করে কথা বলতো।

লতিফা বেগম জানান, চিরকুটে সে লিখেছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ও মা, তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আমি চাই না আমার মা-বাবার সম্মান নষ্ট হোক। আমি আগেই এখানে (বাড়িতে) না থাকার জন্য তোমাদের বলেছিলাম। কিন্তু তোমরা আমার কথা রাখো নি। আমার মৃত্যুর পর তোমরা আর এখানে থেকো না। কারণ এখানে থাকলে আর কেউ লেখাপাড়া শিখতে পারবে না। তাই তোমাদের কষ্ট হলেও এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেও। মা, সত্যি কথা বলছি, রাহাতের সঙ্গে আমার কোন খারাপ সম্পর্ক ছিলো না। তবে রাহাত এবং অন্যরা আমার নামে যে মিথ্যা কথা বলে অপবাদ দিয়েছে তার বিচার আল্লাহ করবে। আমি আল্লার কাছে বিচার দিয়ে গেলাম, দেখো আল্লা একদিন ওর বিচার করবেই। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।’

আরজু মনির মা লতিফা বেগম অভিযোগ করে বলেন, রাহাত এবং তার বন্ধুবান্ধব আমার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়ার পর আমি বিষয়টি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের জানাই। এরপর গ্রামবাসী এক শালিস বৈঠকের মাধ্যমে রাহাতকে শাসিয়ে দেয়ার পরেও সে থেমে থাকেনি। একের পর এক হুমকি-ধামকি দিয়ে বেড়িয়েছে। ওদের ভয়ে আমি মেয়েকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিই।

ঘটনার দিন গত ২০শে এপ্রিল আনুমানিক বেলা ১১টার সময় আমি মেয়ের জন্য নোটবুক কিনতে বাজারে যাই। প্রায় এক ঘন্টা পর ফিরে এসে দেখি আমার মেয়ে আরজু মনি তার শোবার ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ সময় তার হাতের লেখা একটি চিরকুটও পাওয়া যায়। এ ঘটনায় গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে অপমৃত্যু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের এসআই মো. আউয়াল হোসেন রানা জানিয়েছেন, স্কুলছাত্রী আরজু মনির আত্মহত্যার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত লিখিত কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

গোপিনাথপুর গ্রামের রাহাত নামে এক যুবকের উত্ত্যক্তের কারণে ওই স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করেছে পরিবারে এমন অভিযোগের প্রেক্সিতে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, স্কুলছাত্রী আরজু মনির ময়নাতদন্তের পর ঘটনা তদন্তকালীন এলাকার একাধিক মানুষ সুত্রে জানা গেছে, রাহাতের সঙ্গে আরজু মনির দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গেলো উপজেলা নির্বাচন পরবর্তী তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে আদালতে গিয়ে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে করেছিল। এরপর উভয়পক্ষের লোকজন তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দেয়ার কথা বলে বাড়িতে নিয়ে আসে। এ সময় কথা হয়, কিছুদিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে দেয়া হবে। কিন্ত সেটা আর হয়ে ওঠে না।

এসআই মো. আউয়াল হোসেন রানা জানান, মেয়ের মা লতিফা বেগম মেয়েকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে সবসময় চোখের নজরে রাখতে শুরু করে। এক সময় রাহাতের  সঙ্গে আরজু মনির যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমন ঘটনার পর রাহাত তার বিবাহিত স্ত্রীকে ফিরে পেতে আরজু মনির বাড়ির সামনে গিয়ে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানায়। কিন্ত তার মা লতিফা রাহাতকে একসময় সোজাসুজি জানিয়ে দেয়- তোমার সঙ্গে আমার মেয়ে বিয়ে দেবো না। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে আরজু মনির মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে সে।

ঘটনার দিন গত ২০শে এপ্রিল আনুমানিক বেলা ১১ টার সময় আরজু মনির মা লতিফা বেগম মেয়ের জন্য একটি নোট বুক কিনতে বাজারে যাওয়ার সময় আরজু মনিকে ঘরের ভেতরে আটকিয়ে রেখে দরজায় তালা লাগিয়ে বাজারে যায়। প্রায় ১ ঘন্টা পর বাজার থেকে বাড়ি ফিরে দরজা খুলে লতিফা বেগম তার মেয়ের লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখে চিৎকার করলে লোকজন জড়ো হয়। উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

তাহলে আরজু মনির মৃত্যুর জন্য কে দায়ি? এমন প্রশ্নের উত্তরে এসআই আওয়াল রানা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর জন্য তার মা লতিফা বেগম, রাহাত ও সমাজ দায়ি। কারণ সমাজ এবং তার মা লতিফা বেগম তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দেয়ার কথা বলে বিয়ে না দেয়ায় রাহাত মেয়ের মাকে বকাবকি করেছে। এ কারণেই সে আত্বহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে রাহাত ও তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031