ছয় বছর আগে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তার মুলে ছিলো অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বিশেষ করে ব্লগারদের একটি অংশ বাংলাদেশে ।
ওই আন্দোলন চলাকালেই ঢাকার মিরপুরে খুন হয়েছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার। এরপর একে একে বিভিন্ন সময় খুন হয়েছেন আরও কয়েকজন ব্লগার।
অন্যদিকে শাহবাগের আন্দোলন শেষ হবার পরে নানা সময়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেছেন সুপরিচিত কয়েকজন ব্লগার।
ব্লগার আরিফ জেবতিক বিবিসি বাংলাকে বলছেন বাংলা ব্লগিংয়ের সেই ক্রেজ এখন আর নেই।
“তবে এর কারণ আসলে ওই অর্থে হুমকি বা খুনের ঘটনাগুলো নয়। এগুলোর একটা প্রভাব হয়তো কিছুটা আছে। কিন্তু ব্লগিং কমে যাওয়ার মূল কারণ সেই প্রযুক্তিই।”
তার মতে, তখন ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগের অন্য মাধ্যমগুলোও ছিলোনা বলেই ব্লগিং জনপ্রিয় হয়েছিলো। কিন্তু এখন সবাই নিজের ফেসবুক পাতায় লিখছে এবং মূহুর্তে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।
আরেকজন সুপরিচিত ব্লগার বাকী বিল্লাহ বলছেন এটা ঠিক যে ২০১৩ সালে বাংলা ব্লগিংয়ের বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে শাহবাগের কারণে।
“কিন্তু কমিউনিটি ব্লগিং (কোনো একটা ব্লগিং প্লাটফরমে অনেকে মিলে লেখা) আসলে ততদিনে কমে আসতে শুরু করেছিলো। বরং ব্যক্তিগত ব্লগিং বেড়ে যাচ্ছিলো তখনি। এরপর যখন ফেসবুক আসলো তখন আর সেটার প্রয়োজনীয়তাই থাকলোনা।”
ব্লগারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৫ সালের দিকে মূলত বাংলা ব্লগিং শুরু হয়েছিলো।
কয়েক বছরের মধ্যে বাংলা প্রায় ৫শ ব্লগিং সাইট বিশ্বব্যাপী দেখা যায়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয় সামহোয়ার ইন ব্লগ ও সচলায়তনসহ আরও কয়েকটি। ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর ঘুরে ফিরে এসেছে এই ব্লগার ও ব্লগিং বিষয়গুলো।
ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলাম শাহবাগ আন্দোলনের পরপর ৮৪ সাল ব্লগারের নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করেছিলো।
এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন খুন হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে আবার কয়েকজন আটক হয়ে জেল খেটেছেন।
আবার ওই তালিকার কয়েকজন হামলা ও হুমকির শিকার হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন।
প্রচলিত ধারার বাইরে বেশ কিছু কমিউনিটি ব্লগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
তেমনি একটি পেচাব্লগ.কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক তরুণদের একটি অংশ অত্যন্ত সক্রিয় ছিলো এই ব্লগে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকা এই ব্লগের সদস্য ছিলো এক হাজারেরও বেশি।
ব্লগটিতে মূলত রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এসব বিষয়ে ক্যাম্পেইন হতো বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন এর এডমিন এনায়েত শাওন।
“আমরা এসব বিষয়ে ক্যাম্পেইন করেছি এটা সত্য। তবে নোংরা বা অশ্লীল লেখাও প্রকাশ করতে দিতামনা। তারপরেও একের পর এক হুমকির মুখে শেষ পর্যন্ত বন্ধই করে দিয়েছি।”
তার মতে ব্লগিংয়ের বিরুদ্ধে এতো বেশি পাল্টা ক্যাম্পেইন হয়েছিলো যে সাধারণত কবি সাহিত্যিকরাও ব্লগ থেকে সরে ব্যক্তিগত পেজ খুলতে শুরু করে দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ফেসবুক আসার পর।
এনায়েত শাওন বলেন, “ফেসবুকে যখন বাংলায় আনলিমিটেড লেখার সুযোগ তৈরি হলো তখন সেটিই মূলত ব্লগিংয়ে ধ্বস নিয়ে এসেছে।”
প্রায় একই মত দিয়েছেন আরিফ জেবতিকও।
তিনি বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন সহজে কথা বলা যায়। অল্প কথাতেও বোঝানো যায়। সে কারণে বেসিক লেখালেখিটাও কমে এসেছে। বলা যায় প্রজন্মের পরিবর্তন এসে গেছে প্রযুক্তির হাত ধরে।”
আবার মোবাইল হাতে হাতে এসে পড়ায় ব্লগিংয়ের চেয়ে ফেসবুকেই বেশি সক্রিয় সবাই, যার প্রভাব পড়েছে ব্লগিংয়ে, বলছিলেন মিস্টার জেবতিক।
আর বাকী বিল্লাহ বলছেন ব্লগিং বিষয়টাকে পরিকল্পিতভাবে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
“শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের অনেকেই ব্লগার ছিলেন সেটাই হয়তো এর কারণ ছিলো। তবে ব্লগার পরিচেয় খুন হওয়ার মধ্যে এমনো আছে যারা কোনোদিন ব্লগিং করেননি।”
সামহোয়ারইন ব্লগে অত্যন্ত সুপরিচিত এই ব্লগার বাকী বিল্লাহ বলছেন, “এখন ফেসবুকেই লিখি। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার এক্সপানশনটাই আসলে ব্লগিংয়ের প্রতি সবার আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। আর অন্য ঘটনাগুলোর কিছু প্রভাব তো ছিলোই।”
তিনি বলেন ব্লগের জায়গায় ফেসবুক ঠিক তেমনি ফটো ব্লগিংয়ের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে ইন্সটাগ্রাম।