একটি স্বাভাবিক ঘটনা কোনকিছু ভুলে যাওয়া এবং বয়সের সাথে সাথে মানুষের ভুলে যাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই ভুলে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করাটাও স্বাভাবিক। অনেক বেশি ভুলে যাওয়াটাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর নির্দিষ্ট পরিমাণ কীভাবে নির্ণয় করবেন? ভুলে যাওয়া আপনার স্বাভাবিক বয়স বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে নাকি অন্য কোন মারাত্মক সমস্যার লক্ষণ তা কীভাবে বুঝবেন? নিউরোসায়েন্টিস্ট ও চিকিৎসকেরা এর সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু তারা সাধারণ ভুলে যাওয়া ও মারাত্মক ধরণের স্মৃতির সমস্যা যেমন- ডিমেনশিয়ার মধ্যে কিছু পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। ডিমেনশিয়া হলে ক্রমশ স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে এবং ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজের উপর হস্তক্ষেপ করে।
স্বাভাবিক বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটির সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও স্মৃতিশক্তির পরিবর্তন হয়। এর ফলে মস্তিস্কের জন্য ক্ষতিকর অনু বা প্রোটিন এর সংখ্যা কমাতে অক্ষম হয়ে পড়ে মস্তিষ্ক। কোষের শক্তি উৎপন্নকারী উপাদান মাইটোকন্ড্রিয়া কমতে থাকে। কিন্তু এই ধরণের পরিবর্তন আলঝেইমার্স বা সেরিব্রোভাস্কুলার ডিজিজের চেয়ে আলাদা। যখন মস্তিস্কের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা ঠিকমত কাজ করতে পারেনা তখন স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে।
কিছু মানুষের মনে রাখার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি ঠিক যেমন কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় গণিতে বা অ্যাথলেটিক্সে ভালো। স্বাস্থ্যবান মানুষেরও স্মৃতিভ্রংশের সমস্যাটি হতে পারে। হারবার্ড ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির প্রফেসর ড্যানিয়েল স্কেকটার স্মৃতি সংক্রান্ত ৬টি ত্রুটির কথা বর্ণনা করেছেন। এই সমস্যাগুলো বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু যদিনা তারা চরম আকার ধারণ করে বা ক্রমাগত না হয় তাহলে ডিমেনশিয়া হিসেবে বিবেচনা করা যাবেনা।
১। নশ্বরতা
এতে সময়ের সাথে সাথে তথ্য বা ঘটনা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। নশ্বরতা বা অস্থায়িত্ব স্মৃতির দুর্বলতার একটি লক্ষণ। মস্তিষ্ক বিজ্ঞানীরা একে উপকারি হিসেবে গণ্য করেন। কারণ এতে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায় ফলে নতুন স্মৃতির জন্য জায়গা সৃষ্টি হয় যা তার জন্য অনেক বেশি কার্যকরী হতে পারে।
২। অন্যমনস্কতা
আপনি যখন খুব মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করেন বা শুনেন তখন এই সমস্যাটি হতে পারে যেমন- আপনি ভুল জায়গায় আপনার চশমাটি বা গাড়ির চাবিটি রাখলেন। কারণ আপনি সেই সময় অন্য চিন্তা করছিলেন, তাই মস্তিষ্ক এই তথ্যটি নিরাপদে সংরক্ষণ করতে পারেনি। অন্যমনস্কতার ফলে নির্ধারিত সময়ের কাজ করতে ভুলে যায় মানুষ যেমন- কারো সাথে সাক্ষাতের কথা ভুলে যায়।
৩। ব্লকিং
স্মৃতি উদ্ধারের অস্থায়ী অক্ষমতাই হচ্ছে ব্লকিং। এক্ষেত্রে কোন তথ্য স্মৃতিতে ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকলেও কোন কারণে মনে করা যায়না। ব্লকড মেমোরি একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত থাকে এবং আপনি ভুলটাকেই উদ্ধার করেন। এই প্রতিদ্বন্দ্বী স্মৃতির কারণেই আপনি যা মনে করতে চাইছেন তা মনে না পড়ে অন্য কিছু মনে পড়ে ঠিক যেমন- আপনি আপনার ছোট ছেলেকে ডাকছেন বড় ছেলের নাম ধরে।
৪। মিসঅ্যাট্রিবিউশন
এই ধরণের সমস্যা তখনই ঘটে যখন আপনি কোন বিষয়ের কিছুটা অংশ সঠিকভাবে মনে করতে পারেন কিন্তু বেশিরভাগ অংশই ভুলভাবে মনে করেন যেখানে স্থান, কাল ও পাত্র জড়িত। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্মৃতির অন্যান্য সমস্যার সাথে এই ধরণের সমস্যা হওয়াও স্বাভাবিক। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত- বয়সের সাথে সাথে বিস্তারিত তথ্য মনে রাখতে আপানার সমস্যা হয় এবং দ্বিতীয়ত- বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্মৃতিশক্তিরও বয়স বাড়তে থাকে। ওল্ড মেমোরিতে মিসঅ্যাট্রিবিউশন হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।
৫। সাজেস্টিবিলিটি
পরামর্শ ক্ষমতায় স্মৃতির এই ধরণের দুর্বলতা দেখা যায়। কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আপনি তথ্য পান। আপনার শৈশবে ঘটেনি এমন ঘটনা স্মরণ করার ক্ষেত্রে প্রধান অভিযুক্ত হচ্ছে সাজেস্টিবিলিটি।
৬। পক্ষপাত
স্মৃতি সম্পর্কে একটি প্রচলিত মিথ হচ্ছে – সঠিক উদ্দেশ্য ও সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতায় আপনি যা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন তাই সে রেকর্ড করে। বাস্তবে আপনার অনুভূতি প্রভাবিত হয় ব্যক্তিগত গোঁড়ামির দ্বারা যেমন- আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, জ্ঞান এবং ওই মুহূর্তে আপনার মেজাজের উপর নির্ভর করে। মস্তিষ্কে যখন স্মৃতি প্রোথিত হয় এবং পুনরুদ্ধার হয় উভয়ের ক্ষেত্রেই এই বিষয়গুলো কাজ করে। মানুষের অবসন্ন হওয়ার প্রবণতা বেশি যেমন- তারা ইতিবাচক তথ্যের নেয়ে নেতিবাচক তথ্য বেশি মনে রাখে।
যদি আপনি আপনার স্মৃতিশক্তি নিয়ে চিন্তিত হন তাহলে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। রোগ নির্ণয়ের জন্য আপনার সম্পূর্ণ ইতিহাস জানার প্রয়োজন হতে পারে, শারীরিক পরীক্ষাও লাগতে পারে, বিভিন্ন ধরণের টেস্ট করতে হয় এবং রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে একমাস বা একবছর সময় লাগতে পারে। কখনো কখনো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যসমস্যা অথবা আবেগিয় সমস্যার চিকিৎসা করলে স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়। যদি প্রারম্ভিক ডিমেনশিয়া শনাক্ত করা যায় তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে স্মৃতি সংরক্ষণে সাহায্য করা যায় এবং স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ধীর গতির করা যায়।
চিকিৎসক যেভাবে ডিমেনশিয়া শনাক্ত করেন :
আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় “ডায়াগনোসিস, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ট্রিটমেন্ট অফ ডিমেনশিয়া : এ প্রেক্টিকেল গাইড ফর প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান্স” নামে।
সাধারণ বয়স বৃদ্ধিতে – ব্যাক্তি স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার কথা বললেও কখন ও কি পরিস্থিতিতে ভুলে গিয়েছিলেন তা বলতে পারেন।
ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে – স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস না করলে বলেন না এবং কখন তার স্মৃতি লক্ষণীয়ভাবে কমে গিয়েছিলো তা স্মরণ করতে পারেন না।
সাধারণ বয়স বৃদ্ধিতে – তার অনুভূত ভুলে যাওয়ার অভ্যাসের বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের চেয়েও নিজে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন।
ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে – ব্যক্তির চেয়ে পরিবারের সদস্যরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন।
সাধারণ বয়স বৃদ্ধিতে – গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সম্পর্ক ও কথোপোকতনের জন্য সাম্প্রতিক মেমোরির বৈকল্য হয়না।
ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে – ঘটনা ও বাক্যালাপের জন্য সাম্প্রতিক মেমোরি লক্ষণীয়ভাবে কমে যায়।
সাধারণ বয়স বৃদ্ধিতে – ব্যক্তি মাঝে মাঝে শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন।
ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে – ব্যক্তি খুব ঘন ঘন ই শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন