প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লরেঞ্জো তান বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তদন্তের মুখে থাকা ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) পদত্যাগ করেছেন। গতকাল শুক্রবার থেকেই তার পদত্যাগ কার্যকর হবে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আরসিবিসির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ব্যাংকের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে পরিচালনা পর্ষদকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেই তিনি পদত্যাগ করেছেন।’ তবে অভ্যন্তরীণ তদন্তে বাংলাদেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ব্যাংকটির বিধিমালা ও নীতিমালা লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
ফিলিপিন্সের ইতিহাসে মুদ্রা পাচারের সবচেয়ে বড় এই ঘটনার তদন্ত শুরুর পর আরসিবিসির এই শীর্ষ নির্বাহীর পদত্যাগের আগে ব্যাংকটির ট্রেজারার ও নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট রাউল ভিক্টর তান গত এপ্রিলে পদ ছাড়েন। তানের মতো তাকেও সব ধরনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এই কর্মকর্তার অধীনেই কাজ করতেন মাকাতি শহরে আরসিবিসির জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতো, যিনি এই ঘটনার অন্যতম প্রধান চরিত্র। চুরি যাওয়া অর্থের একটি অংশ তার এই শাখায় থাকা কয়েকটি অ্যাকাউন্ট হয়ে স্থানীয় তিনটি ক্যাসিনোতে চলে যায়।
আলাদা এক বিবৃতিতে তান বলেন, ‘কোনো অপরাধের অভিযোগ থেকে আমি মুক্তি পেলেও আরসিবিসির প্রেসিডেন্ট ও সিইও হিসেবে ব্যাংকের ইতিহাসে দুঃখজনক এই ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ নৈতিক দায় স্বীকার করছি। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি অনুভব করছি যে, সময় এসেছে সামনে এগিয়ে চলার ও অন্য কোথাও আমার সেবা দেওয়ার।’
নিউইয়র্কের যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার করে ফিলিপিন্সের এই ব্যাংকে রাখা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় দেশটির সিনেটের চলমান তদন্তের কেন্দ্রে রয়েছে আরসিবিসি। এদিকে চুরি যাওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে এর মধ্যেই আদালতে মামলা করেছে ফিলিপিন্সের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কাউন্সিল (এএমএলসি)।
ফিলিপিন্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট অ্যাকুইনো আগামী ৩০ জুন ক্ষমতা ছাড়ার আগেই ‘উদ্ধারযোগ্য’ সব টাকা ফেরত দেওয়া যাবে বলে দেশটির সিনেট কমিটির আশা। এএমএলসির মামলার পর বাংলাদেশের অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন ২০ দিনের জন্য স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে ফিলিপিন্সের একটি আদালত। এর মধ্যেই এএমএলসির কাছে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অংয়ের ফেরত দেওয়া অর্থের একাংশও আদালত জব্দ করতে বলেছে বলে দেশটির গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। এছাড়া ফিলিপিন্স ন্যাশনাল ব্যাংকে (পিএনবি) এই ক্যাসিনো ব্যবসায়ীর নামে ৪ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন পেসোর, ক্যাসিনো অপারেটর ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি লিমিটেডের ৫ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন পেসো ও আরসিবিসিতে ব্যবসায়ী উইলিয়াম গোর ১৯ হাজার ৯৮৩ পেসোর অ্যাকাউন্টও জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাতিয়ে নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলারের একটা অংশ হাতে আসার কথা স্বীকার করেছেন কিম অং। তবে চুরি করে ওই অর্থ নেওয়ার বিষয়টি তার জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন তিনি। এই ক্যাসিনো জাঙ্কেট এজেন্টের কাছ থেকে এরই মধ্যে তিন দফায় মোট ৯৮ লাখ ডলার ফেরত এসেছে বলে ফিলিপিন্সের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
কিম অংয়ের পক্ষ থেকে গত ৩১ মার্চ ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং ৪ এপ্রিল আট লাখ ৩০ হাজার ৫৯৫ ডলার এএমএলসির তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য দেওয়া হয়। পরে গত সোমবার তার কোম্পানি ইস্টার্ন হাওয়াইয়ের পক্ষ থেকে আরও ২০০ মিলিয়ন পেসো (প্রায় ৪৩ লাখ ডলার) দেওয়া হয়েছে।
প্রথম দুই দফায় তার ফেরত দেওয়া অর্থ কর্তৃপক্ষকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে বলেছে আদালত। অংয়ের আরও আড়াইশ মিলিয়ন পেসো ফেরত দেওয়ার কথা রয়েছে।
অংয়ের ভাষ্যমতে, বেইজিংয়ের শুহুয়া গাও এবং ম্যাকাওয়ের ডিং জিজের নামে দুজন জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের ওই অর্থ ফিলিপিন্সে নিয়েছিলেন।
‘ডিং গ্রুপ’র ১০৭ মিলিয়ন পেসোর একটি অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে ম্যানিলার সোলাইরি রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে ওই গ্রুপের জুয়াড়িদের কক্ষ থেকে আরও ১ দশমিক ৩৪৭ মিলিয়ন পেসো জব্দ করে তারা। এই অর্থ ফেরত দিতে আদালতের আদেশের অপেক্ষায় আছে তারা।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভুয়া নির্দেশনা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকে পাঠানো হয়।
ওই ব্যাংকের চারটি অ্যাকাউন্ট থেকে ওই অর্থ ক্যাসিনোর জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয় বলে স্থানীয় পত্রিকাগুলি খবর প্রকাশ করে।