অপরাধীদের সংখ্যা বাড়ছে নগরীর অপরাধ জগতে কিশোর ও তরুণ । এদের বেশির ভাগই সবে অপরাধ জগতে পা রেখেছে। পেশাদার না হয়েও ছিনতাই, চুরি–ডাকাতি, অস্ত্র পাচার, মাদক ব্যবসা, এমনকি খুনের ঘটনায়ও তারা জড়িয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে আছে সমাজের নিচু শ্রেণি থেকে শুরু করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরাও।
কেন এরা অপরাধে জড়াচ্ছে? এর প্রধান কারণ হিসেবে মা–বাবার অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। পাশাপাশি সঙ্গ দোষ, মাদকাসক্তি, আকাশ–সংস্কৃতি, কল্পনা বিলাসী মনের টানে পছন্দের হিরোকে অনুকরণ, পারিবারিক অথবা ব্যক্তিগত হতাশা, দারিদ্র্য ও কুসংস্কারজনিত কারণে কিশোর–তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। মাস্তানি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে সহজেই তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসছে আইন–শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধানে।
সিএমপি কমিশনার মো. ইকবাল হায়দার আজাদীকে বলেন, কেবল আইন প্রয়োগ করে এ অপরাধ প্রবণতা রোধ করা যাবে না। সামাজিক সচেতনতা জরুরি। এ নগরীতে আমরা যারা বাস করি, তাদের একজনের সাথে আরেকজনের রক্তের সম্পর্ক না থাকতে পারে, সামাজিক সম্পর্ক আছে। সেহেতু আমাদের সামাজিক কিছু দায়িত্বও আছে। এই অবস্থার প্রতিকারে তিনি সামাজিক সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আরো বলেন, এদের ক্ষেত্রে আমরা যে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করছি তা হলো, মা–বাবা বাচ্চাদের গাইড করেন না। বেকারত্ব, অশিক্ষা এবং মাদকাসক্তি নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এটা একটা সামাজিক সংকট। তবে আমরা এ সংকট দূরীকরণে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছি। যেগুলো কার্যকর করতে পারলে এ সংকট অনেকাংশে দূর হবে বলে আমার বিশ্বাস। জানা গেছে, আগামী ১১ মে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে সর্বশেষ র্যাব–৭ এর পক্ষ থেকে নগরীর ৪১৭ জন কিশোর অপরাধীর একটা তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সিএমপির পক্ষ থেকে এ ধরনের তালিকা না হলেও ইভটিজারদের একটা তালিকা হয়েছিল। তালিকা অনুযায়ী নগরীতে ইভটিজারের সংখ্যা ৮১৮ জন। এর মধ্যে কোতোয়ালীতে আছে ১১৯ জন, বাকলিয়ায় ৬২ জন, খুলশীতে ১৯৬ জন, বায়েজিদে ২৫০ জন, পাঁচলাইশে ৭৭ জন, চান্দগাঁওয়ে ৬০ জন, ডবলমুরিংয়ে ৭ জন, পাহাড়তলীতে ১৭ জন ও বন্দর থানা এলাকায় ২৩ জন। পতেঙ্গা, কর্ণফুলী ও হালিশহর থানা এলাকার কারো নাম এ তালিকায় নেই। তবে বর্তমানে এ তালিকাটি ফাইলের মধ্যে চাপা পড়ে আছে।
নগরীর খুলশী থানার শহীদ শাহজাহান মাঠ থেকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গত ৩ মে ভোর ৫টার দিকে নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের মধ্যে চারজনের বয়সই ২০ বছর। এরা হলো লোকমান হোসেন (২০), জুয়েল (২০), আলী আহমেদ হোসেন ওরফে সাগর (২০) ও নুর ইসলাম প্রকাশ মনির (২০)। তাদের কাছ থেকে ২টি ছোরা, ১টি স্টিলের চাপাতি, ১টি ফোল্ডিং চাকু, ফ্র্রেমসহ ১টি হেকসো ব্লেড, ৩টি কাঠের বাটযুক্ত রেত, হাতুড়ি, টেস্টার, রেঞ্জ, প্লায়ার্স উদ্ধার করা হয়েছে।
তার দুদিন আগে ১ মে ভোরে নগরীর নতুন রেলস্টেশন এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতি নেয়ার সময় নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়া সাতজনের মধ্যে চারজনই ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী। এই চারজন হলো মনসুর আলী (২০), সজিব (১৮), বাহাদুর (২০) ও রুবেল (১৮)। তাদের কাছ থেকে ৩টি ছোরা, ৩টি মোবাইল, ১টি শাবল, ২টি লোহার রড উদ্ধার করা হয়েছে।
একই দিন ডাকাতির প্রস্তুতিকালে কর্ণফুলী থানা পুলিশের হাতে কালা আক্তার ও তার তিন সহযোগী বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। এদের মধ্যে সেজান (১৮) নামে তার এক সহযোগীও ধরা পড়ে, যে কালা আক্তারের সঙ্গে ডাকাতিতে সরাসরি অংশ নেয়।
গত ২৬ এপ্রিল আকবর শাহ থানার উত্তর কাট্টলী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারা যায় রাসেল নামের এক ডাকাত। তার বয়স ২০ বছর। পুলিশ জানায়, এসময় ১৭ থেকে ২০ বছর বয়সের আরো ৫ জন ধরা পড়ে। ধরা পড়া এসব অপরাধী হলো রুবেল, আলাউদ্দিন, মনির হোসেন, মোহাম্মদ রানা ও মো. রুবেল–২।
২৫ এপ্রিল মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জে তিন গরুচোরকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা। এরা হলো মাইন উদ্দিন বাদশা (১৯), শরিফ উদ্দিন (১৮) ও মোহাম্মদ ওসমান (১৮)।
২৪ এপ্রিল নগরীর পাঁচলাইশ থানার বাদুরতলা এলাকায় দিনে–দুপুরে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নগদ ১৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে ছিনতাইয়ের ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। গ্রেপ্তার চার ছিনতাইকারীর মধ্যে তিনজনের বয়সই ২০ বছর। এরা হলো মো. আব্দুল্লাহ আল নোমান (২০), ডালিম ওরফে সোহেল (২০) এবং তারিকুল ইসলাম লিসান (২০)।
২২ এপ্রিল ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে নগরীর প্রবেশপথে অস্ত্রসহ সুমন চক্রবর্তী (১৯) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সুমনের কাছ থেকে একটি দেশি তৈরি এলজি ও পাঁচ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে।
২১ এপ্রিল নগরীতে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অপহরণকারীরা হলো মহিম আজম চৌধুরী (২০), অনন্য বড়ুয়া রনি (২০), সুমন গাজী (২০), মিজানুর রহমান (২০) ও তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার জুঁই (২০)। ৮ এপ্রিল ডিজেল কলোনি এলাকায় ক্রিকেট খেলার মাঠে মোবাইল ফোন নিয়ে পাঁচ কিশোরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় আমির হোসেনের। এসময় আমিরকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ওই কিশোররা। পরে তাকে উদ্ধার করে পাঁচলাইশ এলাকায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে তার মৃত্যু হয়।
সমাজতত্ত্ববিদ এবং মনোবিজ্ঞানীদের অভিযোগ, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত শিশু–কিশোর ও তরুণদের সংশোধন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে বয়স বাড়িয়ে জেল–হাজতে পাঠানো হচ্ছে। তারা বলেন, এতে অপরাধীরা সংশোধিত না হয়ে আরো বড় ধরনের অপরাধী হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন প্রক্রিয়ায় শিশু–কিশোররা লোহার খাঁচায় বন্দি হয়ে গেছে। যার কারণে তাদের শরীর চর্চা এবং বিনোদনের মাধ্যমগুলো হারিয়ে গেছে। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। শিশু–কিশোরেরা এখন টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও আড্ডাতেই বেশি মগ্ন থাকে। ছোট বয়সেই তাদের কাঁধে তুলে দেয়া হচ্ছে বই–খাতার বস্তা। ঘুম থেকে ওঠার পর রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তাদের কোনো অবসর নেই। এভাবে তাদের সঠিক মানসিক বিকাশের পথ ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।