কোরবানি ঈদের বাকি আছে আর মাত্র পাঁচদিন আগামী ২২ আগস্ট ঈদুল আযহা। সেই হিসেবে। ইতোমধ্যে নগরীর স্থায়ী অস্থায়ী ৮টি পশুর হাটের ইজারাদাররা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। বাজারের মাঠজুড়ে সারিবদ্ধভাবে বাঁশ বেঁধে ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যয় এবারও উত্তরাঞ্চলসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রচুর পশুর সমাগম ঘটছে। এছাড়া ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারের পশুও দেখা মিলছে বাজারে। খামারিদের দিনভর এসব পশুর সেবা যত্ন করে সময় কাটাতে দেখা গেছে। এখনো পর্যন্ত বাজার না জমলেও খামারিদের আশা, আজ শুক্রবার ছুটির দিনে বাজারে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে পারে। অন্যদিকে অনুমোদনহীন অবৈধ পশুর বাজার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইজারাদাররা। এ ব্যাপারে তারা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এছাড়া বাজারে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের চিকিৎসকরা পশুর স্বাস্থ্যগত দিকটি ক্রেতাদের নিশ্চিত করবেন বলে জানা গেছে।
কয়েকজন পশু ব্যবসায়ী জানান, গত বছরের তুলনায় এবছর পশুর সরবরাহ বেড়েছে। ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারের পশুর সাথে স্থানীয় পশু যুক্ত হলে পশুর সংকট থাকবে না। ফলে পশুর দাম কমারও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নির্দিষ্ট বাজারে পশুবাহী ট্রাক আসার পথে জোরপূর্বক অন্য বাজারে পশু নামাতে বাধ্য করছেন। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি ছাড়া তারা বিভিন্ন মাঠ, সড়ক ও রেললাইনের পাশে খুটি পুঁতে পশু বিক্রি করছেন। ইজারাদারদের দাবি, পুলিশের চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটলেও রসহস্যজনক কারণে তারা নির্বিকার। জানা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) স্থায়ী বাজার সাগরিকা ও বিবিরহাট ছাড়াও আরো ৬টি অস্থায়ী বাজার ইজারা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অস্থায়ী বাজারগুলোতে প্রচুর পশুর সমাগম হয়েছে। এসব বাজারের মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী নুর নগর হাউজিং এস্টেট, কাটগড় গরুর বাজার, সল্টগোলা গরুর বাজার, স্টিল মিল গরুর বাজার, কমল মহাজন হাট গরুর বাজার ও পোস্তারপাড়ের ছাগল বাজার। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে আরো কিছু পশুর বাজার।
গতকাল নগরীর সাগরিকা ও বিবির হাট পশুর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সারিবদ্ধভাবে খুটি পুঁতে বেঁধে রাখা হয়েছে অসংখ্য গরু–মহিষ। তবে বাজারে এখনো চট্টগ্রামের স্থানীয় গরু আসেনি। দেশিয় গরুর মধ্যে কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ, যশোর, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ীদের গরুর পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেছে। এছাড়া বাজারে কিছু সংখ্যক ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের গরু এসেছে। আজ আরো অনেক পশুবাহী ট্রাক আসবে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
সাগরিকা বাজারে আসা চাঁপাইনবাবগঞ্জের খামারি মো. আবদুল হালিম বলেন, প্রতি বছর এই বাজারে আমি গরু নিয়ে আসি। এ বছরও ৩৫টি গরু নিয়ে এসেছি। সবগুলো আমার নিজস্ব খামারের। তবে এর মধ্যে কিছু ভারতীয় গরু রয়েছে। গত ৬ মাস আগে কিনে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে পরিচর্যা করেছি। তবে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ মতে মাঝে মাঝে গরুকে ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়াতাম।
বিবিরহাট বাজারে আসা পাবনার খামারি শহীদুল ইসলাম বলেন, গত চার বছর ধরে আমি বিবিরহাট বাজারে গরু নিয়ে আসছি। এ বছর আমরা ১৬ ব্যবসায়ী মিলে ২১০টি গরু এনেছি। সবগুলো দেশিয় গরু। আমাদের নিজস্ব খামারে এসব গরু উৎপাদন করেছি। এ বছর প্রচুর গরুর সরবরাহ রয়েছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বিবিরহাট বাজারের কয়েকজন পশু ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, প্রতি বছর কোরবানির সময় মৌসুমী পশু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তারা স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের নাম ভাঙিয়ে খুঁটি গেড়ে গরু বেচাকেনা করে। অনেকসময় একপ্রকার জোর করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পশুবাহী ট্রাক তাদের পছন্দের বাজারে নামাতেও বাধ্য করে। এছাড়া সড়কে বিভিন্ন মহলকে চাঁদা দিতে হয়। এতে ব্যবসায়ীদের পশু পরিবহন থেকে শুরু করে বাজারে নামানো পর্যন্ত বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়।
এদিকে গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, বিবিরহাট রেললাইনের পাশে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই খুঁটি পোঁতা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার মাঠে এক প্রকার জোরপূর্বক পশুর বজার বসিয়েছিল প্রভাবশালী মহল। তবে এবার মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পশুর বাজার না বসানোর জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করে। মাঠে তাই এবার বাজার না বসলেও রেললাইনের আশপাশে খুঁটি পুঁতে বাজার বসানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
বিবিরহাট পশু বাজারের ইজারাদার জামশেদ খান বলেন, এবার কোরবানিতে পশুর বাজারের প্রস্তুতি গত বছরের তুলনায় বেশ ভালো। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশুবাহী ট্রাক এসে বাজারগুলোতে ভরে উঠছে। যত্রতত্র বাজার বসিয়ে কেউ যেন খুঁটি বাণিজ্য করতে না পারে সেজন্য আমরা প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করেছি। প্রশাসনও আমাদের আস্বস্ত করেছে। এছাড়া বাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বক্ষণিক পুলিশ নিয়োজিত আছে। আশা করি সমস্যা হবে না। এরপরেও কোনো মহলের ইন্ধনে যদি খুটি পুঁতে বাণিজ্য করা হয় তাহলে আমরা লোকসানের মুখে পড়ব। কারণ কোটি কোটি রাজস্ব দিয়ে আমরা বাজার ইজারা নিয়েছি।
চট্টগ্রাম গবাদি পশু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি হাজী মো. শফিকুর রহমান বলেন, বাজারে ইতোমধ্যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রচুর গরু এসেছে। এরমধ্যে মিয়ানমার ও নেপালের গরুও আছে। যদিও পশুর বাজার এখনো জমে ওঠেনি। রাখার সমস্যার কারণে শহরের মানুষ একেবারে শেষ মুহূর্তে পশু কিনে থাকনে। আশা করি আগামীকাল (আজ) বাজারে ক্রেতা সমাগম বাড়বে। বেচাকেনাও ভালোভাবে শুরু হবে।
সাগরিকা পশু বাজারের ইজারাদার সাইফুল হুদা জাহাঙ্গীর বলেন, আমাদের প্রস্তুতি এবার আগের যেকোনো বছরের তুলনায় ভালো। বাজারে প্রচুর সংখ্যক সমাগম ঘটেছে। এছাড়া প্রশাসন আমাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছে। তবে নগরীতে অনেক অবৈধ পশুর বাজার গড়ে উঠেছে। ইতেমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নিকট আমরা তালিকা দিয়েছি। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ফইল্ল্যাতলী পশুর বাজার, কর্র্নেল হাট পশুর বাজার, মৌসুমি আবাসিক এলাকার পশুর বাজার, বাইন্না পাড়া পশুর বাজার। পাহাড়তলী থানাকে অবহিত করেছিলাম। তারা ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা এখনো নেয়নি।
জানতে চাইলে চসিকের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট জাহানারা ফেরদৌস দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন জায়াগায় অবৈধ পশুর বাজার গড়ে উঠছে এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আগামী রোববার থেকে আমরা এসব অবৈধ বাজারের বিরুদ্ধে অভিযানে নামব।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রেয়াজুল হক বলেন, নগরী ও উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন পশুর বাজারে জেলা প্রাণিসম্পদের ৮২টি মেডিকেল টিম কাজ করবে। মেডিকেল টিমের বিশেষজ্ঞরা কোনো পশুর রোগ বালাই আছে কিনা সেই বিষয়ে ক্রেতাদের পরামর্শ দিবেন। চলতি বছর ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৪১৪টি পশু জবাইয়ের লক্ষ্যমাত্রা করেছি আমরা। এরমধ্যে আমাদের মজুদ আছে পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ৬৩৪টি পশু।যেহেতু স্থানীয় পশুর বাইরে দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর পশু বাজারে এসেছে তাই বলা যায় এবার পশুর সংকট হবে না।