শিক্ষার্থীরা দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় ৯ দফা দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে গতকাল বিক্ষোভ করেছে । একই সময়ে চট্টগ্রাম নগরীর গরীবুল্লাহ শাহ মাজার এলাকায় একটি বাস কাউন্টার ঘেরাও করেও কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন দাবিতে। নগরীতে বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে হানিফ পরিবহনের বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পায়েলকে।
এ দুই কর্মসূচিকে পাশাপাশি রেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবহন ব্যবস্থার ওপর চরম অনাস্থা তৈরি হওয়ায় একেবারে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছেন সাধারণ লোকজন। অতীতেও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সেক্ষেত্রে সীমিত সময়ের প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। এবার যেন রীতিমত পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করার লক্ষ্যেই মাঠে নেমেছেন তারা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ সাধারণ লোকজন বলছেন, পরিবহন সেক্টরে প্রতিদিনই নানা নৈরাজ্য হচ্ছে। রোজ দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, আবার এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে সংশ্লিষ্ট যানের চালকের জন্য। আবার পরিবহন সেক্টরের শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরাও যেন এসব বিষয়ে উদাসীন। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই চাপা ক্ষোভ ছিল সাধারণ যাত্রীদের। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু এ ক্ষোভকে যেন আরো বাড়িয়েই দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত রোববার দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। আহত হন আরো ১৫ শিক্ষার্থী। ঘটনার পর পর দায়ী চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। পরদিন সোমবার এবং গতকাল মঙ্গলবারও তারা বিক্ষোভ করে। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পাওয়ার অনেকগুলো কারণের একটি দায়িত্বশীলদের ‘অপরিপক্ব আচরণ’। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় হাসিমুখে কথা বলতে দেখা যায় নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে। মন্ত্রীর হাসির ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ এজন্য মন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি পদত্যাগের দাবি জানান। পরবর্তীতে সোমবার নৌ মন্ত্রীকে ডেকে সংযত হয়ে কথা বলার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ নৌ মন্ত্রী গতকাল সেদিনের হাসিমুখের অভিব্যক্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, সারা দেশে গত জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় তিন হাজার ২৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কিছু ঘটনা আলোচিত হওয়ার পর মামলা হয়েছে এবং দোষী চালককে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রভাবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। এছাড়া সরকারি হিসাব মতে, সারা দেশে ৩২ লক্ষ গাড়ির নিবন্ধন আছে। এর বিপরীতে মাত্র ২৫ লক্ষ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পেক্ষাপটে ঢাকায় গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। একইসঙ্গে বিআরটিএ এবং ডিএমপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভাকক্ষে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, বিআরটিএ ও বিআরটিসিসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে অনুষ্ঠিত সভা থেকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এদিকে বিভিন্ন সময়েও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে এবারের সিদ্ধান্তও কতটুকু বাস্তবায়ন হয় সেটাও লক্ষ্যণীয়।
এ বিষয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বিবিসিকে বলেছেন, অতীতে এ ধরনের সাময়িক ব্যবস্থার কথা বলে সড়ক নিরাপত্তার ওপর বৈধ আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার কঠোর হতে চাইলেও বাস–ট্রাকের মালিক ও শ্রমিকরা এ নিয়ে হরতাল শুরু করেন, ভাঙচুর করেন। ফলে সরকার ভয় পেয়ে যায়। ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, সরকারের ভেতরে থাকা পৃষ্ঠপোষকদের জন্যই বাস মালিক এবং ড্রাইভাররা আজ এতটা বেপরোয়া আচরণ করছে।
এদিকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে, চালকদের বেপরোয়া গতি, পথচারীদের অসতর্কতা, লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও মালিকপক্ষের নানা অব্যবস্থাপনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিহ্নিত কারণগুলোর ওপর জোর দিলেই চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রায় প্রতিদিন সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসবে। কিন্তু এই নিয়ে যেন কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে বন্ধ হচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনাও। এতে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।
করিম নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আজাদীকে বলেন, বুয়েটের সুপারিশগুলো তো ছিলই। পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সময়ে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমে আসত। এক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ থাকলে আশ্বস্ত হতেন সাধারণ মানুষ। সেই আস্থা তৈরি হয়নি বলেই ক্ষুদ্ধ লোকজন রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।