শিক্ষার্থীরা বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে রাজধানীর বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ ও দিনভর বিক্ষোভ করেছে । ক্যান্টনমেন্ট ও উত্তরার ১০ থেকে ১২টি কলেজের প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। গতকাল সকাল থেকে পৌনে ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় শিক্ষার্থীরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করলে পুলিশও ছাত্রদের উপর পাল্টা লাঠিচার্জ করেন। এতে কয়েক শিক্ষার্থী আহত হন। এদিকে, মিরপুর ও সায়েন্সল্যাব এলাকায়ও বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
দিনভর চেষ্টার পর বিমানবন্দর সড়কে বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল মারতে মারতে শেওড়ার দিকে সরে যায়। পরে সড়কে যান চলাচল শুরু করে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কটি দীর্ঘ পৌঁনে ৬ ঘণ্টা অবরোধের কারণে প্রচণ্ড যানজট তৈরি হয়। যা ছড়িয়ে পড়ে নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্রে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল ১০টার দিকে কুর্মিটোলার হাসপাতালের সামনে থেকে উত্তরা পর্যন্ত রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্টের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ভাষানটেক সরকারি কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, গুলশান ডিগ্রি কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, বনানী বিদ্যানিকেতন কলেজ, বিএফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা শাহীন কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীসহ আশপাশের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে। এতে যানজট প্রধান সড়ক ছাড়িয়ে এলাকার অলিগলি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় উভয়দিকের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় বাসের যাত্রীরা জ্যামে নাকাল হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহমর্মিতা জানিয়েছেন অনেকেই। এ সময় শিক্ষার্থীরা রেল লাইনে অবস্থান নিলে বেলা দেড়টা থেকে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন শেওড়া রেল লাইনের উপর বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ফলে ঢাকা থেকে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশন মাস্টার মোজাম্মেল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশনের কাছে শেওড়া এলাকায় রেল লাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে সাময়িকভাবে রেল যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তীতে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তারা অবরোধ তুলে নিলে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ শুরু হয়। অবরোধের কারণে হজযাত্রীরা আটকা পড়েছে জানিয়ে সড়ক ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন পুলিশ ও রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষকরা। পরে কয়েকজন হজযাত্রীকে বহনকারী গাড়ি ও মোটরসাইকেল ছেড়েছে শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি মহিউদ্দিন সরকার ও রমিজউদ্দিন কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক উম্মে কুলসুম শিক্ষার্থীদের রাস্তা ছেড়ে বাড়ি ফেরার কথা বলেন। তারা ছাত্রদের আশ্বস্ত করে বলেন যে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছাড়েনি।
এদিকে, নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি আদায়ে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। দুপুর পৌনে ১টায় শিক্ষার্থীদের পক্ষে শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী শাহীন সিফাত সংবাদ সম্মেলন করে এ আলটিমেটাম দেন। ৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে, বেপরোয়া ঘাতক ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে, নৌ-পরিবহন মন্ত্রীকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকাতে স্পিড ব্রেকার দিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে, শুধু ঢাকা নয়, সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করতে দেয়া যাবে না, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।
এদিকে, অভিযুক্ত বাসচালক ও হেলপারদের বিরুদ্ধে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় রোববার রাতে নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীমের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহান হক মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গতকাল (সোমবার) ভোরে রাজধানীর মিরপুর থেকে ওই দুই বাসচালক ও তাদের সহকারীসহ চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব-১ উপ-অধিনায়ক মেজর ইশতিয়াক আহমেদ গণমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসচালক হলো জুবায়ের ও সোহাগ। তবে, তাদের সহায়তাকারীদের নাম জানা যায়নি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে, কুর্মিটোলার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় কুর্মিটোলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সড়ক অবরোধ করেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ২টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান গেটের সামনে প্রায় ২০০ শতাধিক শিক্ষার্থী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় তারা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। তবে, সেখানে কোনো গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। পরে তারা সেখানে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসের চালক ও হেলপার ও মালিককে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান। গুলশান জোনের পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল আহাদ মানবজমিনকে জানান, খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। মূল সড়ক থেকে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়।
এ ছাড়াও, প্রায় একই সময় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ধানমণ্ডির সায়েন্স ল্যাবরেটরির শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তারা দোষী গাড়িচালক ও হেলপারের বিচার দাবি করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা একটি বাসের সামনের অংশ ভাঙচুর করে। তখন বাসের মধ্যে থাকা ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শেখ ইমন এবং বাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একই কলেজের শিক্ষার্থী তুর্য (১৮) আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় পথচারীরা দুই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আহত ইমন ঢামেক হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, তিনি কলেজ থেকে বাসায় যাওয়ার সময় ওই বাসে ওঠেন। বাসটি বিক্ষোভকারীদের পাশ দিয়ে যেতে চাইলে সেটিতে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় তিনি আহত হন। আহত তুর্য জানান, তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় বাসটিতে ভাঙচুর চালানো হলে কাচ ভেঙে তার মাথায় ঢুকে যায়।
ধানমণ্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ জানান, শিক্ষার্থীেেদর বিক্ষোভ চলাকালীন একটি বাস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এ ছাড়াও গতকাল দুপুর ১টার দিকে রাজধানীর বাড্ডা রোডের গুলশান কমার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে সড়কের পাশে অবস্থান নেন। সেইসব প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘মা, আমি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চাই’, হে সড়ক, আর কতো প্রাণ ঝরাবে তুমি’, ‘স্টপ কিলিং ইত্যাদি। তবে, সেখানে কোনো সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেনি। এ সময় গুলশান কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী বাহাউদ্দিন বলেন, সড়কগুলো মরণফাঁদে পরিণত হচ্ছে। এভাবে আর কত লাশ পড়বে? তিনি ঘাতক চালকের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।