ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে বুধবার রাত থেকে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন । বিক্ষোভের পর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তারা ঘোষণা দিয়েছেন, গ্রেপ্তার নেতাদের কারাগারে রেখে তারা ক্লাসে ফিরে যাবেন না। তাদের মুক্তির আগ পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি চলবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার প্রতিবাদ, হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা, আটকদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রীরা অংশ নেন। তাদের দাবি এ কর্মসূচিতে আসতেও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। বিক্ষোভকারীরা নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
সকাল ১১টায় রোকেয়া হল থেকে সাধারণ ছাত্রীরা ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’ ব্যানার সংবলিত একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে শামসুন্নাহার হলের সামনে অবস্থা নেয়। এ সময় অভিযোগ ওঠে- শামসুন্নাহার হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শারমিন জেসমিন শান্তা ও সাধারণ সম্পাদক নিপু তন্নী ওই হলের মেয়েদের আন্দোলনে আসতে বাধা দেন। ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী অভিযোগ করেন, হলের ছাত্রলীগ নেতারা আন্দোলনে আসতে বাধা দিলে এক মেয়ে সেটি ভিডিও করলে তার ফোন কেড়ে নেন শান্তা ও নিপু। ভিডিও করায় ওই মেয়েকে আইসিটি আইনে মামলাসহ বিভিন্ন হুমকি দেয়। এ সময় কবি সুফিয়া কামাল হলসহ অন্যান্য হলের ছাত্রীরাও উপস্থিত হলে বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে টিএসসি হয়ে কলা ভবন, বিজনেস ফ্যাকাল্টি, বিজয় একাত্তর হল, সূর্যসেন হল, ভিসি চত্বর হয়ে লাইব্রেরির সামনে এসে অবস্থান নেয়।
এ সময় লাইব্রেরির গেটে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এসে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের কটূক্তি করে। পরে বিক্ষোভকারীরা আবার টিএসসিতে এসে সমাবেশ করে। এদিকে সাধারণ ছাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিলের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায়। মিছিলের সামনে পিছনে উচ্চ গতিতে বাইক মহড়া দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করে। মিছিলে অংশ নেয়া জাকিয়া পারভীন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে। এখন পর্যন্ত তাদের কোনো বিচার হয়নি। আমরা নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই। সেই দাবিতে এখানে এসেছি।’ এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা অভিযোগ করে ছাত্রলীগ বহিরাগত নেত্রীদের দিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দিচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে ভয়ভীতি। এর আগে গত বুধবার রাত ১১টার দিকে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এর কিছুক্ষণ পর একই দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে শামসুন্নাহার হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলেও। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয় হলগুলো। ঘণ্টাব্যাপী চলে এ বিক্ষোভ। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অভিভাবক সুলভ আচরণের দাবি জানান। বিক্ষোভকারী ছাত্রীরা ‘ক্যাম্পাসে হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার ভাই আহত কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার বোন লাঞ্ছিত কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার ভাই রিমান্ডে কেন প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। এদিকে গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিভাগে ক্লাস পরীক্ষা হয়নি।
আটকদের না ছাড়লে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে
দুপুর দেড়টার দিকে রোকেয়া হলের প্রধান গেটের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারী ছাত্রীরা। এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আফসানা সাফা আটকদের মুক্তি ছাড়া ক্লাসে না ফেরার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের ভাইদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার বিচার চাই। বোনদের ওপর নির্যাতনের বিচার চাই। আমরা এমন ক্যাম্পাস চাই না। আমরা চাই নিরাপদ ক্যাম্পাস। আমাদের নিরপরাধ ভাইদের আটক করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা অবিলম্বে তাদের মুক্তি চাই।’
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মানববন্ধন
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মশিউর রহমানকে আটকের প্রতিবাদ ও অবিলম্বে মুক্তি চেয়ে মানববন্ধন করেছেন বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। এতে বিভাগটির শিক্ষক শিক্ষার্থী ও মশিউরের বাবা-বোন অংশ নেয়। মানববন্ধন থেকে মশিউর ছাড়া ক্লাসে না ফেরার ঘোষণা দেয় তার সহপাঠীরা। বিভাগটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর দায় এড়াতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি, আমাদের কোনো ধরনের খবর না জানিয়ে, আমাদের ছাত্রদের জেলহাজতে নিয়ে যাবে সেটা কাম্য না। অনতিবিলম্বে মশিউরসহ সবাইকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করছি।
তিনি বলেন, যদি তাকে ফিরিয়ে না দেয়া হয় তাহলে যদি বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। আর সামগ্রিকভাবে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব ফেলবে। আমরা চাই শান্তিতে বসবাস করতে। মানববন্ধনে বিভাগের ছাত্রী তিথী বলেন, মশিউর আমাদের সহপাঠী ও নিয়মিত শিক্ষার্থী। সে আমাদের সঙ্গে ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাস করবো না। সমাজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতার বিরুদ্ধে। সেই দাবিও যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে জানানোর পরিস্থিতি না থাকে তাহলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জাজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে এটা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আমি ভাবিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রকে মানববন্ধনে দাঁড়ানোর প্রতিবাদে তাকে নির্মমভাবে পেটানো হবে। অহিংস আন্দোলনের বিরুদ্ধে সহিংসতা করে আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাবমূর্তি মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন।
ছাত্রলীগের মানববন্ধন: এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ‘অস্থিতিশীল’ করার প্রতিবাদ জানিয়ে বহিরাগতদের নিয়ে মানববন্ধন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী’দের ব্যানারে এ মানববন্ধনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি হোম ইকোনমিক কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের ছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তারা অভিযোগ করেন, কোটা সংস্কারের নামে কিছু শিক্ষার্থী অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তাদের আন্দোলনে এখন সাধারণ শিক্ষার্থী নেই। এ জন্য তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এ সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তানভীর হাসান সৈকত বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দুই পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষ হামলা চালিয়েছে। ছাত্রলীগ ওই সব হামলা চালায়নি। তবে ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও শহীদ মিনারে কোটা সংস্কারকারীদের ওপর হামলায় এই ছাত্রলীগ নেতাও জড়িত বলে অভিযোগ আছে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মানববন্ধনে ইডেন কলেজ শিক্ষার্থীদেরও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।