সাংবাদিককে আটক করে থানার নেয়ার হুমকি দিয়েছেন গাজীপুরের এসপি হারুন অর রশিদ সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলাকালে কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় । এ ঘটনায় উপস্থিত অন্য পুলিশ সদস্যরাও বিব্রতবোধ করেন। দুপুরে গাজীপুর সদরের শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের বিষয়ে পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাতে চটে গিয়ে তিনি মানবজমিন-এর একজন প্রতিবেদককে আটক করে থানায় নিয়ে যেতে বলেন পুলিশ সদস্যদের। পরে ঘটনাস্থলেই তাকে কিছু সময় আটকে অপ্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চাওয়া হয়। পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি হারুন বলেন, ওই সাংবাদিক ঝামেলা করার চেষ্টা করছিল।
এ বিষয়ে ঘটনার শিকার প্রতিবেদক জানান, গতকাল সকাল ১০টার পর গাজীপুর চৌরাস্তায় পশ্চিম চান্দনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনে যান এসপি হারুন। সেই কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথ থেকে বিএনপি এজেন্টদের বের করে দেয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থানের বিষয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর অভিযোগ সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি তার বক্তব্য দেন। এরপর গাজীপুর সদরের শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রেও ভোট কেটে নেয়া, জাল ভোট ও এজেন্ট বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। এসপি হারুন ওই কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যসহ বের হচ্ছিলেন। তখন প্রবেশ ফটকের কাছে ওই প্রতিবেদক সেই কেন্দ্রের বিশৃঙ্খলার বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চান। এতে উত্তেজিত হয়ে উটেন পুলিশ সুপার। বলেন, ‘তুমি আগেও আমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেছো। তোমার উদ্দেশ্য কী তা যাচাই করতে হবে। কথা বের করতে হবে।’ এরপর সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ওকে আটক করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করো।
তখন এই প্রতিবেদন বলেন, ‘আপনি তা করতে পারেন। কিন্তু আমার পেশাগত দায়িত্বপালনে বাধা দিতে পারেন না’। এর পরপরই এক উপপরিদর্শক (এসআই) ফটকের ভেতরে রাখা পুলিশ ভ্যানের কাছে নিয়ে যান। সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখেন। বেশ কিছুক্ষণ ওই পুলিশ কর্মকর্তা বিপদের ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘স্যারের মাথা গরম। আর স্যারের সামনে পড়বেন না। অন্য দিকে চলে যান।’ এরপর বিকালে একাধিক টিভি ও অনলাইন সাংবাদিক পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে গেলে তাদের হুঁশিয়ারির ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘এক সাংবাদিককে আটক করেছিলাম। পরে ছেড়ে দিয়েছি।’
এদিকে কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র ধরা পড়ে সকাল থেকেই। সকালে পশ্চিম চান্দনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায় ৩, ৪ ও ৯ নম্বর বুথে ধানের শীষ প্রতীকের কোনো এজেন্ট নেই। কাউন্সিলর প্রার্থীর একাধিক এজেন্ট জানান সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নৌকা প্রতীকের কিছু লোক এসে তাদের জোর করে বের করে দেয়। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল মোক্তাদির বিন মোস্তাইনুর রহমান বলেন, বিএনপি এজেন্টরা সকালে এসে দেখা করে নাম জমা দেন। পরে তারা চাপে পড়ে বা অন্যভাবে চলে গেলে তা আমাকে জানানো হয়নি। এর আগে সকাল ৯টায় ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বড়বাড়ী এলাকার চান্দনা সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের চিত্র দেখা যায়। ওই কেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন আব্দুর রহিম মণ্ডল। তিনি বলেন, আমি উন্নয়নের স্বার্থে নৌকায় ভোট দিয়েছি। ভোট শুরু হওয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়নি। পরে কী হয় জানি না।
এরপর সাড়ে ১০টা। গাজীপুর সদরে জয়দেবপুরের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়। কেন্দ্রটির সামনে ঘুড়ি প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি সমর্থক প্রার্থী ও বর্তমান কাউন্সিলর হান্নান মিয়া হান্নুর কয়েকশ কর্মীর বিক্ষোভ ও মিছিল। তারা কেন্দ্রের ভেতরে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও ঠেলাগাড়ি প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আব্দুল করিমের সমর্থক ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ভোট কেটে নিচ্ছে বলে হৈ চৈ শুরু করেন। এর এক পর্যায়ে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেয়। এতে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তাতে প্রার্থী হান্নুসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এদিকে কেন্দ্রে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই ওই অভিযোগের সত্যতা চোখে পড়ে। শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলার প্রথম বুথে গিয়ে দেখা যায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ভোট দেয়ার জন্য বুথে উপস্থিত ভোটার মীর মো. মোয়াজ্জেম। তার ভোটার নম্বর ৩৩০৬৩৪১৮৭৭৮৬। তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে আধাঘণ্টা আগে আমি বুথে ঢুকে হাতে ব্যালট পাই। এরপর নৌকা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীর কয়েকজন লোক বুথে ঢুকে।
আমার হাত থেকে ব্যালট কেড়ে নেয়। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকেও ব্যালটের মুড়ি কেড়ে নিয়ে এসে এসে সিল মারতে থাকে। তার সামনের টেবিলে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ব্যালটের মুড়ি অর্ধেক অবশিষ্ট থাকলেও মেয়র পদের শেষ হওয়া ব্যালটের মুড়িটি দেখা যায়। ওই কক্ষেও কোনো বিএনপি এজেন্ট পাওয়া যায়নি। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে পাশের ২০২ নম্বর কক্ষেও।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিট। এই বুথে শুধু মেয়র পদের ভোট নয়। একই সঙ্গে কেটে নেয়া হয়েছে কাউন্সিলর প্রার্থীর ভোটও। ওই সময় তাতে নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর ব্যালট ৮১টা শেষ হলেও মেয়র ও কাউন্সির প্রার্থীর ১০০ ব্যালট শেষ হয়ে যায়। ওই বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুস সালাম বলেন, বেশকিছু লোক ঢুকে আমাদের ঘিরে ফেলে। তারপর ব্যালট কেড়ে নিয়ে সিল মারে। আধাঘণ্টা ধরে তা চালানো হয়। এই ঘটনার পর কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট ওই কেন্দ্র পরিদর্শন করলেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। পাশের ২০৫ নম্বর বুথে ভোট কারচুপিতে অংশ নেয় ৭ থেকে ৮ জন। সেখানে আধাঘণ্টার কম সময় তা চালানো হয় বলে জানা গেছে। তাদের সঙ্গে ভোট কেটে নিতে অংশ নেয় ওই কেন্দ্রে উপস্থিত সরকার দলীয় কাউন্সির প্রার্থীর এজেন্ট শাহীন রেজা নিজেও। তিনি তা অস্বীকার করলেও নৌকার এজেন্ট মিজানুর রহমান লিটনও সেই সাক্ষ্য দেন। সেই বুথের পাশেই বসানো হয় ২০৬ নম্বর কক্ষ। সেই কেন্দ্র ভোট কেটে নেয়া হয় শুধু মেয়র পদের। বুথটিতে নারী ও পুরুষ কাউন্সিলর পদের ৯১টি করে ব্যালট খরচ হলেও তখন মেয়র পদের ব্যালট যায় ১০৫টি। ওই কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার সুশান্ত বলেন, চারজন লোক এসে মেয়র পদের ব্যালট কেড়ে নেয়ায় এই পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
ওই কেন্দ্রর নিচ তলার প্রায় সব বুথ থেকেও বিএনপি এজেন্টদেরকে বের করে দেয়া হয়। ৪ নম্বর বুথ থেকে সকাল সাড়ে নয়টায় বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেয়ার কথা জানান কাউন্সিলর প্রার্থীর এক এজেন্ট। নিচ তলার ১ নম্বর বুথ থেকে ধানের শীষের এক এজেন্টকে বের করে দেয়া হলেও চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি আবার ঢুকে পড়েন বুথে। মুক্তা বলেন, ‘এখানে কী? কোনো সাউন্ড নয়। এক্ষনি বের হও। তোমরা থাকতে পারবে না।’ কিছু বলতে না দিয়েই দ্রুততার সঙ্গে কেন্দ্র থেকে আমাদের অনেক এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়। মানবজমিনের প্রতিবেদককে এই কথা বলার পর বুথেই নৌকার এজেন্ট মুক্তা হুমকিধমকি দেন।
ওই কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মিয়া বলেন, বিষয়টি আমরা যাচাইবাছাই করছি। এর প্রধান দায়িত্ব প্রিজাইডিং অফিসারের। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার সাইদুল ইসলাম বলেন, কয়েকটা বুথে সমস্যা হয়েছে। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছে সমস্যা জেনে জানাতে পারবো আসলে কী হয়েছে।
দুপুর ১টা ৫১ মিনিট। পশ্চিম জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-১ গেলে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট শাহাদাত হোসেন বলেন, বেলা ১২টার দিকে আওয়ামী লীগকর্মীরা নৌকা প্রতীকে ভোট মারে। ১০ থেকে ১২টা ভোট কেটে নেয় বলে জানান সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার। তবে তা অস্বীকার করে প্রিজাইডিং অফিসার মো. হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, মুখে বললে বা চোখে দেখলে প্রমাণ হিসেবে তা মানব না। প্রমাণ থাকলে ছবি বা ভিডিও দেখান। পশ্চিম জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ এর ৪ নম্বর বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বলেন, সকালে ৮-১০ লোক এসে ভোট কেটে নিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢুকায়। কিছু ভোট বাতিল করা হয়েছে। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং আব্দুল হামিদ বলেন, কিছু লোক কেন্দ্রে ঢুকে কেড়ে নিয়ে ব্যালটে সিল মেরেছে। কিছু ভোট বাতিল করেছি।
বিকালে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে মদিনাতুল উলুম আলিম মাদরাসা কেন্দ্র-১ এর সরকারদলীয় কর্মীরা ঢুকে নৌকায় ব্যালটে সিল মারে। তা নিয়ে ওই কেন্দ্রেও হৈচৈ’য়ের ঘটনা ঘটে। দুপুরে কেন্দ্রটি ৪ নম্বর বুথে ঢুকে ৩ নারীসহ ১৫ জন লোক উপস্থিত হয়ে ব্যালট কেড়ে নিয়ে নৌকায় সিল মারে। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার হারুনুর রশিদ তা জানান। অনেকটা বিমর্ষ হারুন তখন আতঙ্কিত ছিলেন বলেও জানান অন্যরা। সেই কেন্দ্রেও দেখা যায় কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলরের ব্যালটের মোড়া অবশিষ্ট থাকলেও শেষ হয়ে যায় মেয়র প্রার্থীর ব্যালটের মোড়া। পরে আবার নতুন মোড়া দিয়ে মেয়র পদে ভোট গ্রহণ শুরু করা হয়। এছাড়া ৫ ও ৬ নম্বরসহ আরো কয়েকটি বুথে ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারা হয় বলে জানা গেছে। কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার মো. রেজাউল করিম বলেন, নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা কেন্দ্রে ঢুকে এ ঘটনা ঘটনায়। তখন আমি সেই বুথে ছিলাম না। পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেছে।
অপর দিকে ৩৮ ওয়ার্ডেও বাদশা মিয়া স্কুল কেন্দ্রেও সরকারদলীয় দুজন কাউন্সিল প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কাউন্সিলর প্রার্থী জিল্লুর রহমান মুকুলসহ আরো কয়েকজন আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় মুকুলকে রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। ২৮ নম্বরও ওয়ার্ডের লাগালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুরে বিএনপিদলীয় কাউন্সির প্রার্থী হাসান আজমল ভুঁইয়ার নির্বাচনী ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয়। এছাড়া তার কর্মীদের ধাওয়া করে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। তাতে কয়েকজন আহত হওয়ার খবর এসেছে। ভোটগ্রহণের আগের রাতে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের টিনশেড এলাকায় ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী তাঁতিলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম ঢালীর ওপর হামলা চালানো হয়। মারাত্মক জখম অবস্থায় তাকে তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অভিযোগ নির্বাচনের প্রতিপক্ষ সরকারদলীয় প্রার্থী জাবেদ আলী জবে’র লোকজন এ হামলা চালায়। তবে জবে তা অস্বীকার করেন।