দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রজননকেন্দ্র মিঠা পানির হালদা নদী ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়েছে । শাখা খালগুলো হয়ে বিভিন্ন কারখানার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে হালদায়। ফলে গত কয়েকদিন ধরে হালদা নদীতে রুই, কাতলা ও মৃগেলসহ বিভিন্ন জাতের মাছ মরে ভেসে উঠছে। এছাড়া হালদা সংলগ্ন হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজানের বিস্তৃর্ণ বিলজুড়ে পড়ে আছে বিভিন্ন জাতের মরা মাছ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, যে হারে শিল্পবর্জ্য হালদার পানিতে মিশছে অচিরেই হালদা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে পরিণত হবে। ইতোমধ্যে দূষণের কারণে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এছাড়া বেড়েছে কার্বন–ডাই–অক্সাইড, যে পরিস্থিতি মাছসহ জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রতিকূল। ফলস্বরূপ প্রতিদিন মরছে মাছ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দূষণের শিকার হালদা নদীর শাখাগুলো হচ্ছে– হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের কুয়াইশ, বাথুয়া, হামিদিয়া ও কৃষ্ণখালী খাল এবং মাদার্শা ইউনিয়নের খন্দাকিয়া, কাটাখালী ও মাদারি খাল। স্থানীয়রা জানান, হালদা নদীর পশ্চিম পার্শ্বস্থ হাটহাজারী ও মহানগরের অক্সিজেন এলাকার বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সংযুক্ত খাল হয়ে নদীতে এসে পড়ছে। কর্ণফুলী হয়ে এসে হালদায় পড়ছে চন্দ্রঘোনা পেপার মিল থেকে ভেসে আসা কাষ্টিকযুক্ত পানি। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি।
এদিকে রাউজানের আজিমের ঘাট এলাকায় হালদা নদীতে প্রায় ১৫ কেজি ওজনের মৃত মৃগেল মাছ ভেসে উঠতে দেখেছেন স্থানীয়রা। তারা বলেছেন, মৃগেল ছাড়া নদীতে রুই, কাতলা ও চিংড়ি ভাসতে দেখা গেছে। বিনাজুরী ইউনিয়নের গৌতম বিশ্বাস জানিয়েছেন কাগতিয়া খালের লেলাংগরা গ্রামের কাছে গতকাল পাওয়া গেছে সাত কেজি ওজনের বোয়ালমাছ। এই খাল থেকে স্থানীয়রা গত তিন দিনে ধরেছে এক থেকে দুই কেজি ওজনের আরো অনেক মরা ও আধ মরা মাছ। ইদলপুর গ্রামের বটন বড়ুয়া জানান, এলাকার অনেকেই খালে ভেসে উঠা ছোট বড় চিংড়ি ধরে বাজারে বিক্রি করছে। এছাড়া মগদাই গ্রামের শফিউল জানিয়েছেন মগদাই খালেও অনেক মাছ মরে ভেসে উঠেছে। বিলে পাওয়া গেছে বড় বড় মরা চিংড়ি। বাগোয়ান ইউনিয়নের স.ম. জাফর উল্লাহ বলেছেন, পঁচা মাছের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ নদী খাল বিল থেকে এসব উঠিয়ে মাটি চাপা দিচ্ছে। হালদার তীরবর্তী স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে হালদার সাথে সংযুক্ত সব খালের প্রবেশমুখের ুইচ গেট নষ্ট থাকার কারণে বন্যা কবলিত তিন উপজেলার পানি খাল বিল থেকে দ্রুত সময়ে নামতে পারেনি। তাই জলজ উদ্ভিদ পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। এসব দুর্গন্ধযুক্ত পানি হালদায় মিশে গিয়ে পানি দূষিত করেছে। ফলে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে।
হালদার পানির দূষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, হালদায় কেন মাছ মরে যাচ্ছে, এ বিষয়টি আসলে অধিকতর অনুসন্ধান করা দরকার। শিল্পবর্জ্যের কথা বলা হলেও গত এক সপ্তাহ ধরে তো ঈদের ছুটির কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ। তাহলে শিল্পবর্জ্য কিভাবে পড়লো। আজকে (গতকাল) আমরা হালদার দশটি পয়েন্টে পানি পরীক্ষা করে দেখেছি। যদিও পানির ডিও (ডিজল্ভ অক্সিজেন) অনেক কমে গেছে। তবে স্থানীয়রা আমাদের জানিয়েছেন, বন্যার কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি নামতে না পারার কারণে বিভিন্ন স্থানের আবর্জনা ও আগাছা পঁচে পানিতে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। তাই পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। তবে আসল কারণ অনুসন্ধানে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের চিন্তা করছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট গবেষক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদা এখন মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে। বন্যার পানির কারণে কখনো এভাবে পানি দূষিত হতে পারে না। আমি আগেও অনেকবার হালদার পানি পরীক্ষা করে দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো খারাপ অবস্থা আর কখনো দেখিনি। স্থানীয়রা আমাদেরকে জানিয়েছেন, মূলত অক্সিজেন থেকে এশিয়ান পেপার মিল পর্যন্ত বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য খন্দকিয়া, কাটাখালী ও মাদারি খালে পড়ছে। এসব খালের পানি একেবারে কুচকুচে কালো আকার ধারণ করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বন্যার পানি কখনো এ রকম কালো হাতে পারে না। পানির ডিও এইসব খালে নেমে গেছে মাত্র ১ এ। এছাড়া হালদায় ডিও পাওয়া গেছে মাত্র ২। অথচ হালদায় আমরা কখনো ৫ এর নিচে ডিও পাইনি। এই লেবেলে কোনো জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। আগে এক সময় শুধুমাত্র খন্দকিয়ার অবস্থাই ছিলো সবচেয়ে খারাপ। এখন একইসাথে মাদারি খাল ও কাটাখালী খালও যুক্ত হয়েছে। তিনটি খাল থেকে সমানে কালো পানি হালদায় পড়ছে। সুতরাং হালদার অবস্থা এখন মারাত্মক খারাপ।’