অভিভাবক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে কিশোর অপরাধ দমনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশনায় । এতে বলা হয়েছে, সন্ধ্যার পর কোনো কিশোর বা শিক্ষার্থীকে বাইরে আড্ডা দিতে দেখলে গ্রেফতার করা হবে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম সিএমপি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। সিএমপির প্রতিটি থানায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এখন থেকে সন্ধ্যার পর কিশোর বা শিক্ষার্থীরা বাইরে আড্ডা দিলে তাদের গ্রেফতার করা হবে। আমেনা বেগম বলেন, পরিবারে সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাড়ছে কিশোর অপরাধ। ছোট বিষয় নিয়ে বড় ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারের উচিত তাদের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা, তাদের কাজ মনিটরিং করা। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে থানা পুলিশ কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি বলব, পরিবারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন।
কিশোর অপরাধ যে ভয়ানক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবেন– তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশের সকল সদস্য এতো ভালো, সৎ ও নির্লোভ নয় যে এই নির্দেশনার সুযোগে ওরা অবৈধ অর্থ আদায়ের পথ প্রশস্থ করবে না! কোনো শিক্ষার্থী যদি কোথাও বেড়াতে বের হয়, কিংবা কোচিংয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে যদি সন্ধ্যা হয়ে পড়ে, তাহলে পুলিশের অসৎ সদস্যরা এই নির্দেশনার সুযোগ নিয়ে তার অভিভাবকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অপচেষ্টা করতে পারে। তারা আড্ডা দেয়ার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করার সুযোগ পাবে। আড্ডা না দিলেও একটা বানানো অভিযোগ তৈরি করতে পারে। কেননা শাস্তি হলেও কমছে না পুলিশের অপরাধ প্রবণতা। প্রায় প্রতিদিনই নানা অভিযোগ উঠছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। নানা অপরাধে জড়িত থাকা এবং অপেশাদার আচরণের অভিযোগ ওঠার পর প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরও থামছে না অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের দুর্নীতি–অনিয়ম। পুলিশ সদর দফতর এসব বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও মাঠপর্যায়ে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং উল্টো দৃশ্যই পরিলক্ষিত হচ্ছে। গরু ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাই, মাদক বহন ও ব্যবসা, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ছাড়াও রয়েছে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় কয়েকজনকে প্রত্যাহার ও বরখাস্ত করেছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ অ্যাক্ট–১৮৬১ অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘুদণ্ড, অন্যটি গুরুদণ্ড। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিতকরণ ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ। এছাড়া বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ছোট ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেয়া হয়। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কনস্টেবল থেকে শুরু করে উপ–পরিদর্শক (এসআই) পর্যন্ত সদস্যরা বেশি অপরাধে জড়াচ্ছেন। তারপর রয়েছেন পরিদর্শক মর্যাদার কর্মকর্তারা। এএসপি থেকে শুরু করে আরও উপরের কর্মকর্তার অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে শাস্তি পাওয়ার নজির রয়েছে।
তাই এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সজাগ থাকতে হবে। কিশোর অপরাধ দমন করতে গিয়ে পুলিশের কতিপয় সদস্য যদি তাদের অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধির সুযোগ পায়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর দেশে দেশে একটি সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সেটি হলো কিশোর অপরাধ। কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি, হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদক সেবন, ইভ টিজিংসহ এমন সব ভয়াবহ কাজ ও অঘটন ঘটিয়ে চলছে এবং এমন লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যা অকল্পনীয়। বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সভ্যতার এ চরম উৎকর্ষের যুগে আমাদের ভবিষ্যতের আশা–ভরসার স্থল কিশোরসমাজের এ ব্যাপক বিপর্যয় সত্যিই বড় দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক। এজন্য কিশোরদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা, খেলাধুলা, স্কাউটিং ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সে সঙ্গে তাদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এতে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে সৃজনশীল কাজে বেশি উৎসাহী হবে। পরিবার ও অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। সাথে সাথে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে এই আশ্বাসটুকু পাওয়া জরুরি যে, পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তা তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।