‘ও মন রমজানের রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ বাংলাদেশে ঈদ–উৎসব কখন থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে তার সঠিক ইতিহাস বলা মুস্কিল। যদ্দূর জানা যায়, ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদ–উৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশকিছু আগে থেকেই। বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলমান সুফি, দরবেশ ও ধর্ম–প্রচারকেরা বাংলাদেশে আসেন। এদের অধিকাংশই উত্তর ভারত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। অন্যদিকে আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই বহিরাগত মুসলমান বণিক, ধর্ম সাধক ও ইসলাম প্রচারকেরা নিজস্ব পরিমণ্ডলে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ উদযাপন করতেন। বাংলাদেশে ঈদ–উৎসবের ভিত্তি হিসেবে এর গুরুত্ব একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। মুসলিম ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় উৎসব তথা সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার পরিচয়ের ক্ষেত্রে দুইটি উৎস এক. উত্তর ভারত হয়ে আসা মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আগমনকারী বণিক ও ভাগ্যান্বেষণকারীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক ও জীবন–জীবিকার বিশ্বদৃষ্টির সঙ্গে এবং দুই. বহিরাগত মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদের সঙ্গে পরিচয়।
বাংলাদেশে ঈদ–উৎসব এখন শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বহুমাত্রিক জাতীয় সামাজিক উৎসবও বটে। এর মধ্যে আছে সামাজিক–সাংস্কৃতিক–অর্থনৈতিক–বিনোদনমূলক নান্দনিক নানা বিষয়। বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ছিল ইংল্যান্ড, কলকাতা ও ইসলামাবাদের পশ্চাৎভূমি। ফলে পাটের মৌসুম ছাড়া তাদের হাতে নগদ পয়সা থাকত না। আর কাঁচা পয়সা ছাড়া উৎসব হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি ব্যবসা–বাণিজ্য, চাকরি এবং বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের পাঠানো টাকায় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। তাই ঈদ এখন এত জমজমাট। উৎসব মানেই তো আনন্দদায়ক ব্যাপার, আনন্দজনক অনুষ্ঠান। ঈদে অবশ্য তাই হয়।
ঈদের জন্য একটি বছর সবাই অপেক্ষায় থাকে। ‘ঈদ এসেছে ঈদ এসেছে ঈদ মোবারক/ ঐ আকাশে চাঁদ উঠেছে দেখরে তোরা দেখ/ ধনী গরীব সবার ঘরে আজ,এলো ঈদের খুশি/ ফুটলো আবার দুঃখি জনের মলিন মুখে হাসি/ যাকাত ফিতরা পেয়ে আজ চোখে নাই নিদ/ শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলো এলো খুশির ঈদ/ ফিরনি সেমাই মিষ্টি পোলাও আরও কত খাবার/ বছর ঘুরে ঈদের আনন্দ, ফিরে এলো আবার/ মান অভিমান থাকবে নাকো ভুলে যাবে আজ/ এক কাতারে সামিল হয়ে পড়বে যে নামাজ/ ভাই ভাইকে জড়িয়ে ধরে করবে কোলাকুলি/ মনের দুঃখ, দ্বন্দ্ব ফেছাদ,সবই যাবে আজ ভুলি।’ ঈদ আমাদের আনন্দের সহযাত্রী। যাতে ছোট বড় সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শত্রু–মিত্র, ধনী–দরিদ্রের ভেদাভেদ থাকে না। ঈদ মানে হাসি আর আনন্দ, ঈদের খুশি সবার সঙ্গে ভাগ করে নেই।
ঈদ উৎসব পালনের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। তা হলো– আরবের অন্যান্য সমপ্রদায়ের মধ্যে নানারকম উৎসবের প্রচলিন ছিল। উকাজের মেলা ছিল এ ধরনের একটি বর্ণাঢ্য আয়োজন। এসব উৎসব প্রায়শই নানা অশ্লীল ও রুচিহীন আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ থাকত। অপরদিকে মুসলমানদের জন্য তখন পর্যন্ত কোনো উৎসবের প্রচলন হয়নি। তাদের নিষ্কলুষ বিনোদনের বিষয়টি রসুলুল্লাহ (সা.) গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করেন। হিজরির ২য় সাল থেকেই রমজান মাসের শেষে ঈদ–উল–ফিতর উৎসব উদযাপনের সূচনা হয়।
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবে গ্রামবাংলায় এমন কী শহরেও মেলা বসে। মেলায় লোকশিল্পজাত নানা পণ্যদ্রব্য বিক্রি হয়। বিক্রি হয় খাবার জিনিসপত্র। কোনো কোনো মেলায় নাগরদোলা, ছবির খেলা, পুতুল নাচ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়। নানা ধরনের খেলাধুলা হয়। মুর্শিদি, মারফতি গানের আসর বসে। এসব কিছুই ঈদ উৎসবকে আরো আনন্দময় এবং প্রাণবন্ত করে তোলে।
বাহ্যিক দিক থেকে ঈদ আনন্দময় হয়ে ওঠে নতুন এবং সুন্দর পোশাকে, খাওয়া–দাওয়ায়। বিশেষ করে ছোটদের কাছে। ঈদের নামাজ আদায় শেষে তারা বড়দের সালাম করে। পায় সেলামি, তাতে খুশিতে আটখানা। ফিতরা–দান সে আয়োজনের পূর্ণতা রক্ষায় বিশেষ সহায়তা করে। এই উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণ হয় সর্বাত্মক এবং সর্বজনীন। কারণ সব মানুষ মিলেমিশে গড়ে তুলেছে মানব সমাজ। সেই মানব সমাজের কল্যাণের কথাই বলে ইসলাম। ঈদ এজন্য সকলের জন্য কল্যাণকর একটি উৎসব। ঈদ উৎসব এই শিক্ষা দেয় যে, নিজের সম্পদ নিজে ভোগ করলেই হবে না, সে সম্পদে অন্যেরও অধিকার আছে। কারণ ঈদ উৎসবের মূল বাণী হচ্ছে মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সমপ্রীতি। সকলের মাঝে একতা ও শান্তি। ‘ঈদ এসেছে দুনিয়াতে শিরণী বেহেশতী/ দুষমনে আজ গলায় গলায় পাতালো ভাই দোস্তী/ জাকাত দেবো ভোগ–বিলাস, আজ গোস্বা/ বদমস্তি/ প্রাণের তশতরীতে ভরে বিলাব তৌহিদ/ চলো ঈদগাহে।’
ঈদ–উৎসবের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো খাওয়া–দাওয়া। পোলাও– কোরমা, সেমাই, ফিরনি, পায়েশ, বিরিয়ানি আরো কতো কি।
আমাদের দেশের কিছু ‘কথিত’ ধনী যাকাত, ইফতার–সেহরি সামগ্রী, ঈদবস্ত্র বিতরণের নামে গরিবদের প্রতারণা করে। প্রায় প্রতিবছর পদদলিত হয়ে মারা পড়ে গরিব। এটা রমযানের শিক্ষা নয়। যাকাত সারা বছর দেয়া যায়, কিন্তু ‘কথিত’ ধনীরা রমজানকে বেছে নেয় অধিক পূণ্যের আশায়। সাথে প্রচারের ব্যাপার তো আছেই। ‘জরীর পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধনীরা এসেছে সেথা/ এই ঈদগাহে তুমি কি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা/
নিঙাড়ি কোরান হাদিস ও ফেকা, এই মৃতদের মুখে/ অমৃত কখনো দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বল বুকে/ নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি/ হায় তোতাপাখি, শক্তি দিতে কি পেরেছ একটু খানি।’
ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ভাগাভাগি করার মধ্য দিয়ে সার্থক হয়ে উঠে। ঈদ সবার জন্য অনাবিল আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে আনুক।