গত চার মাসে ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । গ্রেপ্তারের তালিকায় সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। এছাড়া বাকিদের মধ্যে আছেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী। চলতি বছরে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করেছে দুদক। গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ জন সরকারি কর্মকর্তাকে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এর মধ্যে সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কুতুব উদ্দিনও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল হকের গ্রেপ্তারের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম নেয়।
গত ১২ই এপ্রিল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সেগুন রেস্তোরাঁ থেকে দুদকের উপ-পরিচালক নাসিম আনোয়ারের নেতৃত্বে দুদকের একটি একটি দল ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করে নৌ প্রকৌশলী নাজমুল হককে। জানা গেছে, সৈয়দ শিপিং লাইন নামের একটি শিপিং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেয়ে সব আইনগত প্রক্রিয়া শেষে ফাঁদ পাতে দুদক। পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মীকে সেগুন রেস্তোরাঁয় আসার কথা বলেন নাজমুল হক। সেখানে আগে থেকেই ওত পেতে ছিল দুদকের দলটি।
এর আগে বছরের শুরুতে ঘুষসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাজমুল কবীর। গত ৩রা জানুয়ারি যশোর থেকে তাকে ঘুষের দুই লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। দুদক সূত্রে জানা গেছে, যশোর শহরের শেখ মহব্বত আলী নামের এক ব্যক্তি দেশে তৈরি মদের লাইসেন্স (অনুমোদন) নবায়ন করার জন্য নাজমুল কবীরের কাছে দুই লাখ টাকা ঘুষ দেন। ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি হাতেনাতে ধরতে ওই দিন দুপুরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ে ফাঁদ পেতেছিল দুদক। মহব্বত আলীর ঘুষ দেয়ার সময় দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি দল সেখানে অভিযান চালান। অভিযানে নাজমুল কবীরের কাছ থেকে দুই লাখ (এক হাজার টাকার নোট দুই বান্ডিল) টাকা উদ্ধার করেন দুদকের কর্মকর্তারা। গত ১৫ই জানুয়ারি বরিশাল উজিরপুরের ভূমি অফিসের বেঞ্চ ক্লার্ক ফারুক হোসেনকে গ্রেপ্তার করে দুদক। এ সময় তার কাছ থেকে ঘুষের ১০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
একই মাসের ১৭ তারিখ পিরোজপুরের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সেতাফুল ইসলামকে পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে দুদক। ২৩শে জানুয়ারি পটুয়াখালীতে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তাদের একজনের নাম জাহাঙ্গীর আলম এবং অন্যজন হলেন আবুল কাশেম। ২৮শে জানুয়ারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাইদুর রহমান ও কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদার দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন। জানা যায়, ১০ টাকা কেজি দরের ছয় হাজার ৯৯০ কেজি চাল ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিতরণ করে সরকারের দুই লাখ ৫৯ হাজার ৩০৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৩১শে জানুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালাতে উদয়ন চামকা নামের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তার বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ ছিল।
এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে ফেব্রুয়ারি মাসে কুমিল্লা জেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, কিশোরগঞ্জ জেলার হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের অডিটর সহিদুজ্জামান, একই কার্যালয়ের কর্মচারী দুলাল মিয়া, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বেগমগঞ্জ শাখার ঋণ কর্মকর্তা হাফিজ উল্যাহকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থাটি। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসজুড়েও দুদকের গ্রেপ্তার অভিযানে ধরা পড়েন অন্তত চারজন সরকারি কর্মকর্তা। এর মধ্যে রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামকেও ঘুষের ৬০ হাজার টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশ্য এপ্রিল মাসে ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডিসহ চার কর্মকর্তার গ্রেপ্তারের ঘটনা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১০ই এপ্রিল ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হন ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী সহ চারজন। এদিন সকাল থেকে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে দুদকের একটি দল। বাবুল চিশতী ছাড়া গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন- চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ব্যাংকের এসভিপি জিয়াউদ্দিন আহমেদ এবং ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদুর রহমান খান। মামলার নথি থেকে জানা যায়, ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকিং নিয়মাচারের তোয়াক্কা না করে ওই ব্যাংকেরই গুলশান শাখার একটি সঞ্চয়ী হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ নগদে ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমা ও উত্তোলন করেন মাহবুবুল হক চিশতী। তার ছেলেমেয়েদের ও মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন শাখার মোট ২৫টি হিসাবের ১শ’ ৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৯ হাজার ৬শ’ ৪২ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।
ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত গ্রেপ্তারদের ছাড়াও গত চার মাসে আরো কয়েকজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে দুদক। এর মধ্যে রয়েছেন জামান কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার আনিসুজ্জামান, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক, মো. সাইফুল হক, ট্রেজারী অ্যান্ড এএলএম আবু হেনা মোস্তফা কামাল, চট্টগ্রামের আইমান এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহ আলম ও তার ছেলে এসএম পারভেজ আলম। দুদক কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।