হঠাৎ করেই একেবারে নিরন্ন অবস্থা থেকে সম্পদশালী হয়ে গেছেন বেশ কয়েকজন রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, মাদকের কারবার করেই আর্থিক অবস্থা পাল্টে গেছে তাদের।
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর গোদাগাড়ীর সন্দেহভাজনদের বেশ কয়েকজন দিয়েছেন গা ঢাকা। তবে জনপ্রতিনিধিসহ যারা মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে, তারা এলাকাতেই আছেন এবং তাদেরকে এখনও ধরা হয়নি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার মহল্লার নাম মাদারপুর। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, হেরোইনের মহল্লা। কারণ, মহল্লার বেশ কয়েকজন হেরোইনের কারবারে জড়িত। সারাদেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানেও এই মহল্লায় যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মহল্লার বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা হতাশ। ভেবেছিলাম এবার হয়তো এখানকার মাদক ব্যবসা থামবে। কিন্তু প্রশাসনের কেউ এই মহল্লায় অভিযানেই আসছে না।’
মহল্লার মানুষের বক্তব্য, ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা হেরোইনের রুট গোদাগাড়ী। আর এই মহল্লাতেই চলে তার কারবার। এখানে খুচরাও বিক্রি হয়, পাইকারিও বিক্রি হয়।
কারা এই কারবারের সঙ্গে জড়িত, তা জানেন সবাই। কিন্তু মুখ খুলতে আপত্তি। যিনি মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন তার বিরুদ্ধেই উল্টো দেওয়া হয় মাদকের মামলা। এমন নজির অহরহ।
মহল্লার মানুষ বলছেন, হেরোইনের কারবারিরা যথেষ্ট দান-খয়রাত করেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। সাংবাদিক, গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ভাগ বসান তাদের অবৈধ আয়ের পয়সায়।
তবে যারা গ্রামে হেরোইন সেবন করেন, তারা টাকার জন্য অশান্তি করেন পরিবারে। নেশার ঘোরে নানা রকম অপকর্মও হয়।
কিন্তু সীমান্ত পার করে মহল্লায় হেরোইন ঢোকাচ্ছে কারা? সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে অনেকের নাম। তাদের একজনের ডাক না, ‘ট’ অদ্যাক্ষরের। কয়েক বছর আগেও তার তেমন সম্পদ ছিল না। এখন অনেক জমি-জায়গার মালিক তিনি। আছে মাছের পুকুর, ভেড়া, ছাগল এবং হাঁসের খামার। নগরীর থিম ওমর প্লাজায় দোকান কিনেছেন। গোদাগাড়ীর সাগুয়ান গ্রামে রেলওয়ের জমি দখল করে ৩৬টি দোকানও নির্মাণ করছেন তিনি।
ওই ব্যক্তির ধরে মাদকের কারবারে জড়িয়েছেন পার্শ্ববর্তী মহিষালবাড়ি, ডিমভাঙা, শিবসাগর, মাটিকাটা বাইপাস, রেলগেট, আঁচুয়া, বারুইপাড়া, উজানপাড়া, সুলতানগঞ্জ এলাকার বেশ কয়েকজন। কয়েক বছরের ব্যবধানে তারাও এখন শূন্য থেকে কোটিপতি।
গাড়ি-বাড়ির মালিক এসব মাদক বিক্রেতার কেউ কেউ কয়েকবছর আগে ছিলেন মোটর শ্রমিক, ডিম বিক্রেতা, দিনমজুর বা দোকান কর্মচারী।
মহিষালবাড়ি মহল্লার একজন ২০০৪ সালে স্থানীয় বাজারে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করতেন। তার বাবা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নকশি কাঁথা সেলাই করার সুতা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। অভাবের তাড়নায় মহিশালবাড়ি গরুর হাটে করিডরের কাগজ লেখার কাজ করতেন তিনি।
এখন কোটি টাকার সম্পদের মালিক ওই ব্যক্তি। রয়েছে তিনতলা বাড়ি, মাইক্রোবাস, রাজশাহী শহরের নওদাপাড়ায় দামি প্লট, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পেয়ারা বাগান, আম বাগান ও ৭১ বিঘা জমি।
কয়েক বছর আগে নওগাঁয় মাদকসহ ধরা পড়লেও পরে ছাড়া পেয়ে যান হঠাৎ সম্পদশালী হয়ে উঠা এই ব্যক্তি। তবে তিনি গোদাগাড়ী পুলিশের হাতে কখনো ধরা পড়েননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত থেকে এখন কেজি কেজি হেরোইন পাচার করে আনেন তিনি। ভারতের মুর্শিদাবাদের চারজন এর সরবরাহকারী।
সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর গোদাগাড়ীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ এই মাদক কারবাড়ি গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে পলাতক অবস্থাতেও চালিয়ে যাচ্ছেন তার কারবার। তার এ কাজে তাকে সহায়তা করছেন মহিষালবাড়ির আরেকজন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঝে মাঝেই পুলিশের কাছে নির্দেশনা আসে। কিন্তু তারা অধরাই থেকে যান।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে গোদাগাড়ীর রবিউল ইসলাম রবি, নওশাদ আলী, মো. সেলিম, হযরত আলী, নাজিবুর, তোফাজ্জল, হায়দার আলী, সোহেল, সেতাবুর রহমান ওরফে বাবু ও টিপুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের কাছে নির্দেশনা আসে। কিন্তু তারপরও এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোদাগাড়ীতে হেরোইনের কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন সাবেক এবং বর্তমান জনপ্রতিনিধিরাও। এদের মধ্যে দুইজন দুটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য।
গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উঠে আসে গোদাগাড়ী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলামের নাম। আর পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নওশাদ আলী ও বর্তমান কাউন্সিলর মোফাজ্জল হোসেন মোফা। কয়েক বছর আগে মোফার এক কেজি হেরোইনসহ বগুড়ায় এক নারী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন তাকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছিল।
পুলিশের তথ্য বলছে, দীর্ঘ দিন ধরেই গোদাগাড়ীর মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন একজন কাউন্সিলর। তার ডেরায় যাতায়াত থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবারও ওই কাউন্সিলরকে সতর্ক করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি বলেন, দুপুরে মহিষালবাড়ি এলাকার সন্দেহভাজন মাদকের কারবারি বানী ইসরাইল ওরফে ভোদলের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছিল এপিবিএন। এ সময় ওই কাউন্সিলর সেখানে গিয়ে ভোদলের পক্ষে সাফাই গাইছিলেন।
তখন এপিবিএনের একজন সদস্য বলেন, ‘আপনি এখান থেকে চলে যান। আপনার ব্যাপারেও তথ্য আছে।’
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপন করেছেন। তবে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাতে গোদাগাড়ীও পিছিয়ে থাকবে না। খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টি দৃশ্যমান হবে।’
র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহাবুবুল আলম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশল বদলে এখনও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’