সন্ধ্যা নামলে বিভিন্ন এলাকাতেই এক রকম ভোটকা গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসবাসীদের কাছে মোটেই তা অপরিচিত নয়। এই গন্ধের সঙ্গে নিরুপায় একাকার হয়ে আছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।
নেশাদ্রব্য গাঁজার গন্ধে ভারী হয় ক্যাম্পাসের বাতাস। আর বিভিন্ন হল ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকার নালা-নর্দমায় একের পর এক লুটিপুটি খায় ফেনসিডিলের খালি বোতল।
কিন্তু তো রোধে দৃশ্যত কোনো তৎপরতা নেই প্রশাসনের। প্রক্টরিয়াল বডি বলছে, এ ব্যাপারে তাদের দায় নেই, এটি দেখবে পুলিশ প্রশাসন।
তাহলে ক্যাম্পাসের নৈশ প্রহরীরাই বা আর কী করবেন। একজন নৈশপ্রহরীর সঙ্গে কথা হলো এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের নিষেধ কেউ শোনে না। উপরন্তু নিষেধ করলে আমাদের শুনতে হয় গালি, খেতে হয় মার।’ তাই না দেখার ভান করেন তারা।
ক্যাম্পাসে কারা মাদক সেবন করে- এই প্রশ্নের উত্তর সহজে শিক্ষার্থীদের কাছে পাওয়া যায়। কিন্তু কাদের মাধ্যমে ও কীভাবে ক্যাম্পাসে মাদক ঢুকে- এ ব্যাপারে অত সহজে সরাসরি নাম বলতে অপারগ অনেকে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চারটি এলাকা দিয়ে মাদক ঢুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। একটি হলো কামরাঙ্গীরচর-কেরানীগঞ্জ হয়ে আজীমপুর দিয়ে। দ্বিতীয়টি সদরঘাট-পুরান ঢাকা ও চানখারপুল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
এছাড়া মাদকের দুটি বড় চালান ক্যাম্পাস ঢোকে কমলাপুর-শাহাবাগ ও চট্টগ্রাম-ধানমন্ডি হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চারটি রুট দিয়ে আসা মাদকদ্রব্য হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে রিকশাচালক ও পথশিশুরা। এই ব্যবসার জন্য তারা বেছে নেয় ক্যাম্পাসের ময়লা ফুটপাতগুলো যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে।
সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রীক মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৩৮ জনের নাম রয়েছে।
তাদের মধ্যে ২০ জন হলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। যুবলীগের দুজন নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সদস্যের নামও রয়েছে তালিকায়। বাকি ১৫ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা নেই।
তালিকায় নাম আসা এই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উপরন্তু তাদের অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই সব। তারা যেভাবে চায় সেভাবেই তাদের সহায়তা করবে প্রশাসন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী ঢাকাটাইমসকে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি তাদের। ক্যাম্পাসকে মাদকমুক্ত রাখতে চান তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মাদকের ব্যবসা ও সেবন চলে। এসব বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো অভিযান চালাবে কি না, জানতে চাইলে প্রক্টার বলেন, ‘এসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার। আর কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের সহায়তা করতে পারে।’
মাদক ব্যবসা ও সেবনের স্থান
ক্যাম্পাসের পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং ক্যাম্পাসের সায়েন্স এনেক্স ভবন ও কার্জন হল মাদক সেবনের বড় আস্তানা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন সন্ধ্যা সাতটার পর বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু তাতে কমেনি মাদক সেবন ও এর কারবার।
আগে সন্ধ্যার পর উদ্যানের ভেতরে মাদকের আসর বসত, এখন ক্যাম্পাসের পাশের ফুটপাতে বসে আসর। সন্ধ্যার পর গাঁজার গন্ধে ফুটপাত দিয়ে চলা দায় হয়ে পড়ে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সন্ধ্যা হলেই চারুকলা থেকে টিএসসির মোড় হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত উদ্যান ঘেঁষা ফুটপাতে মাদকসেবীদের আনাগোনা শুরু হয়। রাত বাড়তে থাকলে জমতে থাকে আসর। চোখে পড়বে পাঁচ থেকে সাতটি ছোট ছোট জটলা। এসব জটলায় বসে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করতে দেখা যায় অনেককে। উদ্যানের ভেতর থেকে ক্রেতাদের কাছে মাদক সরবরাহ করে বিক্রেতারা।
আরও অভিযোগ আছে, চারুকলা থেকে রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত ফুটপাতে সেবন হয় নেশার উপকরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় বহিরাগতরাও। উদ্যানের গেটের কাছে ভাসমান দোকানদারদের কাছে পাওয়া যায় গাঁজা।
গাঁজা-ফেনসিডিলের আসর ফুটপাতে বসলেও ইয়াবা সেবন করা হয় একটু আড়ালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ হল ও অমর একুশে হলে ইয়াবা সেবন চলে বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহীদুল্লাহ হলের একজন শিক্ষার্থী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসব দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। যারা এসব করে তারা তো পলিটিক্যাল ছেলে।’
‘মাদকের গন্ধে জীবন অতীষ্ঠ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আর প্রশাসনের নীরব ভূমিকা আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের হতাশ করে।’
এ নিয়ে ক্ষোভ আছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনের উদাসিনতার কারণে দিন দিন এই সমস্যা বাড়ছে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, ইয়াবার চালান সাধারণত সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রাম থেকে ক্যাম্পাসে আসে। শহীদ মিনারে এর ভাগবাটোয়ারা হয়। ছাত্রলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এসব চালান নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে সলিমুল্লাহ হলের সাবেক ও বর্তমান দুজন, হাজী মুহসীন হলের একজন ও জগন্নাথ হলের দুজন ছাত্র রয়েছেন। কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বহিরাগতদের মাধ্যমে খুচরা ব্যবসা চালান বলে সূত্র জানায়।
অর্ডার পেলে চানখাঁরপুল, আনন্দ বাজার ও পলাশীর মাদক ব্যবসায়ীরা হলের রুমে ফেনসিডিল পৌঁছে দেয়। তারা পুরান ঢাকার লোক। শহীদ মিনার ও নিউ মার্কেটের পাশে রাস্তার ধারে গাঁজা পাওয়া যায়।
মাদকের মামলা
২০১৪ সালে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল থেকে পাচারের সময় পুলিশ ইয়াবার চালান আটক করে। দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও একটি মোটরসাইকেলসহ সাতজনকে আটক করা হয় তখন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাও করা হয়।
মাদকের এই চালানে হল ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে, কিন্তু ২০১৫ সালের শেষ ভাগে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে ছাত্রলীগের কারো জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা মামলার তদন্তে ছাত্রলীগের কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পাননি।
২০১৫ সালের ৩ মে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। এর সঙ্গে হল প্রশাসনের এক কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। তিনি হল ছাত্রলীগের কয়েকজনের সহায়তায় এই ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ।
একই বছরের ২৫ জানুয়ারি রাতে ফজলুল হক হল থেকে ১৫০ ক্যান বিয়ারসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে দুজন হল শাখা ছাত্রলীগের পদধারী নেতা। তাদের পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় হল শাখা ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও পুলিশি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়।
এর আগে ১৮ জানুয়ারি ছাত্রলীগের মুহসীন হল শাখার সাবেক সহসম্পাদক মো. রাসেল উদ্দিনকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়। এ ঘটনায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
এরপর থেকে আরও কোনো মাদকবিরোধী অভিযান নেই। এই অবসরে ক্যাম্পাসে কেবল বিস্তৃত হয়েছে মাদকের ধাবা।