নানা কারণে মাদক সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর বিচার শেষ করা যাচ্ছে না । আর কারাগারগুলো ঠাসা হয়ে যাচ্ছে মাদক মামলার আসামিতে।
সহজে বিচার শেষ করা যায় না বলে আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই ধরনের অপরাধে জড়িত হয়, বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
মাদকের মামলা এবং বিচারের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে মাদকবিরোধী সাম্প্রতিক সাড়াঁশি অভিযানের পর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের শুরুর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতো প্রচেষ্টার চাইছেন। আর গত ৪ মে থেকে শুরু হওয়া অভিযানে বেশ কিছু ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা নিয়ে আলোড়ন হচ্ছে দেশে।
৪ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল রাত পর্যন্ত মাদক মামলার ১৩ আসামির মৃত্যুর খবর এসেছে কথিত বন্দুকযুদ্ধে। আর ২০ এপ্রিল দিবাগত রাতে এক দিনেই মারা গেছে নয় জন।
নিহতদের সবাই নিজ নিজ এলাকায় চিহ্নিত মাদক কারবারি বলে তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। আর এই অভিযান শুরুর পর মাদক বিক্রির স্পট হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলো ফাঁকা হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় পলাতক আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন না চেয়ে কারাকারে যাচ্ছেন বলেও তথ্য এসেছে।
তবে অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সমালোচনাও উঠেছে। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল মাদক নির্মূলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র পক্ষে নন। তার দাবি, ধরে বিচার করে আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হোক।
এ রকম অভিযানের পক্ষে নয় বিএনপিও। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে বিচারবহির্ভূত হত্যা আখ্যা দিয়ে তা থামানোর দাবি তুলেছেন।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক মামলার বিচার চলে বছরের পর বছর। আর বিচার না আগানোয় আসামিরা জামিন পেয়ে যায় কারাগার থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, স্বাক্ষীর অভাবেই নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না মাদকের মামলা। সারাদেশে কত মামলা ঝুলে রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান অবশ্য নাই অধিদপ্তরে।
সংস্থাটির সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি মামলা হয় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। বছরে বছরে তা বেড়ে যায়।’
মামলা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী-জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সঠিক সময়ের মধ্যেই মামলার তদন্ত শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে থাকি। তবে সঠিক সময়ে আদালতে স্বাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলা শেষ করতে দেরি হয়।’
এই কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, তদন্ত কর্মকর্তারা অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে তারা বিভিন্ন সময়ে বদলি হয়ে যান। বিভিন্ন সময়ে একজন কর্মকর্তার নামে একাধিক সমন আসে। কিন্তু তারা একদিনে হাজির হতে পারেন না। এছাড়াও যাদেরকে স্বাক্ষী করা হয় তারাও ঠিকমত মামলায় স্বাক্ষ্য দিতে আসেন না। ফলে মামলা নিষ্পত্তি করতে সময় লাগে।
ঢাকা জেলা জজ আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবুও স্বাক্ষীর অভাবে মামলা নিস্পত্তিতে বিলম্বের কথা বলেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘পুলিশ মামলা তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু তারা সময় মত আদালতে স্বাক্ষী দিতে আসেন না। আর যাদেরকে বেসরকারি স্বাক্ষী করা হয়, অনেক সময়ে তাদের বর্তমান ঠিকানা ঠিক না থাকায় তাদেরকেও হাজির করা যায় না।’
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব মামলায় যারা আসামি তারা স্বভাবতই সন্ত্রাসে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হয় না মানুষ। আর এসব বিষয়ে জোর করাও যায় না।’
জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ইকবাল হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কারাগারগুলোতে মাদকের মামলার আসামি গড়ে ৪০ ভাগ। কোনো কোনা কারাগারে আসামিদের অর্ধেকই মাদক সংশ্লিষ্ট। কোনটায় কিছুটা কম।’
‘এদের মধ্যে বেশিরভাগই বিচারাধীন মামলার আসামি। আর সাজাপ্রাপ্ত আসামিও রয়েছে।’
৯০ এর দশকে দেশে ব্যাপকভাবে ফেসনিডিল আসক্তির বেড়ে যায়। তবে হাল আমলে মাদকাসক্তদের মধ্যে সিংহভাগই ইয়াবা বড়িত আসক্ত বলে জানিয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর বাইরে হেরোইন, প্যাথিড্রিনের মতো ওষুধ সেবনসহ নানা ধরনের নেশার চল আছে।
তবে ইয়াবার আসক্তি বর্তমানে ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বানিহী থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ পর্যায়কেও। অন্যান্য আসক্তির সঙ্গে ইয়াবা আসক্তির পার্থক্য হচ্ছে, যারা এই নেশা করেন, তাদের স্বজনরাও প্রথমে বুঝতে পারেন না বিষয়টা। আর যখন বিষয়টি প্রকাশ পায়, ততদিনে আসক্তি যে পর্যায়ে চলে যায়, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন।
গত জানুয়ারিতে পুলিশ সপ্তাহ চলাকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতো মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের কথা বলেন শেখ হাসিনা। গত ৩ মে র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও তিনি এই নির্দেশ দেন। আর পরদিন শুরু হয় এই অভিযান।
গত ১৪ মে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের কার্যালয়ের পাশে মাদক ফেলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আর ২০ মে রাজধানীতে মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে শুরু করা এক প্রচার অভিযানে তিনি বলেন, ‘হু এভার, হোয়াট এভার, হয়ার এভার, কেউ আমাদের অপারেশনের বাইরে নয়। মাদকের শিকড়-বাকড়সহ তুলে নিয়ে আসব।’