সাঁড়াশি অভিযান সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে । এই অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মাদক বিক্রেতাদের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গতরাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে কথিত এই বন্দুকযুদ্ধে কমপক্ষে আটজন নিহত হয়েছেন। এভাবে মাদক বিক্রেতাদের দমন সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে করেন লেখক, গবেষক এবং অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘মাদক দমনের জন্য বন্দুকযুদ্ধ নৈতিক দিক দিয়ে সমর্থনযোগ্য নয়। নিশ্চয়ই বিচার করে শাস্তি দেয়া সমর্থনযোগ্য হবে।’

রবিবার মধ্যরাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের একটি টক শোতে অংশ নিয়ে তিনি এই মত দেন। সংবাদপত্র পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘আজকের সংবাদপত্র’সঞ্চালনা করেন মীর মাসরুর জামান।

আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরেই বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। বন্দুকযুদ্ধে সাম্প্রতিক এই নিহতের ঘটনাগুলো অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ী কিংবা মাদকদ্রব্য মাদকসেবীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজে লিপ্ত। তারা নিশ্চিত অপরাধী। কিন্তু বন্দুকযুদ্ধ নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।’

বিশিষ্ট এই সমাজ বিশ্লেষক বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দেশে মাদকদ্রবের ব্যবহার ও প্রচলন  আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে যেসব মাদকদ্রব্য ছিল তার সঙ্গে গত বছর দশকের সঙ্গে নতুন নতুন মাদকদ্রব্য ও কিছু ওষুধ যোগ হয়েছে। এসব ওষুধও মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব মাদকদ্রব্য নিয়ে অনেক অঘটন ঘটছে। খুনোখুনি হচ্ছে, মারামারি হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের নানান ঘটনা ঘটছে।’

‘সরকার ঘোষণা করছে এটাকে দমন করার জন্য। জঙ্গিবাদীদের দমন করার জন্য যেমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তেমনি সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। যার ফলাফল আমার গত কয়েক দিনে দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য এটা সরকারের কর্তব্য। সরকার সরকারের উপায়ে করছে।’

মাদক দমনে মাদক বিক্রেতাদরে আটক করে তাদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে প্রবীণ এই বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘আমার মতো অনেকই নিশ্চয়ই বলবেন, বিচার করে মাদকব্যবসায়ীদের শাস্তি দেয়া হোক। বন্দুকের মাধ্যমে নয়।’

এই গবেষক ও লেখক মনে করেন সমাজের মাদকের প্রচলন বাড়ার অন্যতম কারণ সামাজিক বৈষম্য। এনিয়ে তার ভাষ্য ‘গত ৩০ বছরে সমাজে বৈষম্য অনেক বেড়েছে। যদিও উৎপাদন বেড়েছে, সম্পদ বেড়েছে। কিন্তু ধনী লোকের সংখ্যা বেড়েছে। সাধারণ মানুষেরও জীবনযাত্রা আগের তুলনায় স্বচ্ছল হয়েছে ঠিকই।  ভিক্ষুকের সংখ্যা কিন্তু বেড়েছে। যদিও এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। কিন্তু আমরা পথে ঘাটে চলতে গিয়ে দেখি ১০, ২০ বছর আগে যেমন ভিক্ষুক ছিল তারচেয়েও বর্তমানে ভিক্ষুক বেড়েছে। আর ধনী গরিবের বৈষম্য অনেক বেড়েছে। সম্পদ উৎপাদন হচ্ছে, সম্পদ জমা হচ্ছে কিন্তু এগুলো অল্প কিছু পরিবারের হাতে রয়েছে।’

‘পাকিস্তান আমলে এক সময় ২২ পরিবারের কথা হতো। এখন পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। হয়তো ২২ পরিবারের জায়গায় ২২ শ পরিবার হয়েছে। কিংবা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সম্পদের পরিমাণ জমা হওয়ার পরিমাণের চেয়েও বর্তমান কিছু লোকের কাছে অনেক অনেক গুণ বেড়েছে।’

তরুণ মাঝে সর্বনাশা মাদক ঢুকে পড়ার অন্য কারণ কারণ নৈতিক স্খলন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই যে অসাম্য সামাজিক অবিচার, জুলুম জবরদস্তি, ঘুষ দুর্নীতি, ঋণখেলাপি, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ এসব কিছুর দ্বারা এমন একটা সামাজিক অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, তরুণদের মধ্যে অপরাধমূলক প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। সমাজের কোনো নৈতিক স্ট্যান্ডার্ড পাওয়া যাচ্ছে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ এই শিক্ষক মনে করেন,  দেশে আইনের শাসন আছে। কিন্তু আইনের শাসের ব্যতায় ঘটছে। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোর্টে বিচারের রায় হচ্ছে। সেই আদালত চত্বরেই রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে আইনজীবীরা বলছেন এই রায় মেনে নেবার মতো নয়। এই রায় উদ্দেশ্যমূলক। এই জাতীয় ব্যাপার এখন বেশি ঘটছে। বিশেষ করে কোর্টকে অমান্য করে অনেক কিছু বলা হচ্ছে। কাজেই আইনের শাসনের লঙ্ঘন আমাদের সমাজে বেড়ে গেছে।  এই পরিবেশের মধ্যে ড্রাগের প্রচলন ও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। একই সঙ্গে পরকীয়াও বেড়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদিও সরকারি অফিসে নারীরা চাকরি করছেন। কিন্তু তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তারা সেটা নীরবেই সহ্য করছেন। এগুলো মেনে নিয়েই তারা তাদের কাজ করছেন। এর ফলে ভেতরে ভেতরে পারিবারিক অশান্তি বেড়ে যাচ্ছে। পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। বাড়ছে পরকীয়া। ফলে স্বামী কিংবা স্ত্রী হত্যাও বেড়েছে। আত্মহত্যার পরিমাণও বেড়েছে।’

এই সমাজটাকে ঘুণে ধরা সমাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক কথায় বলা যায় সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। সমাজের পচন ধরেছে। এগুলো থেকে উত্তোরণের জন্য রাজনৈতিক কিংবা বিভিন্ন বামপন্থী, ডানপন্থী বা মধ্যমপন্থীদের মধ্যে কোনো অনুসন্ধান দেখা যায় না। যারা বুদ্ধিজীবী বলে সমাজে পরিচিত। তারাও এই ব্যাপারে নীরব। একমাত্র এনজিওগুলোই মাঝেমধ্যে এই নিয়ে গবেষণা করেন। যার ফলাফল আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই। কিন্তু এই গবেষণা সীমিত আকারে।’

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031