র‌্যাবের অভিযান চালানোর কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে মাদক ব্যবসা নগরীর মাদকের হাট খ্যাত বরিশাল কলোনিতে। এবারই প্রথম নয়, নিয়মিত দেখা যায় এ দৃশ্য। র‌্যাব, পুলিশ কিংবা মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর অভিযান চালায় আর তা টের পেয়ে পালিয়ে যায় বিক্রেতারা। অভিযানকারী টিম চলে গেছে নিশ্চিত হলে পুনরায় ফিরে আসে। গত বৃহস্পতিবারও তাই হয়েছে। গভীর রাতে বরিশাল কলোনিতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ১২ মামলার মামলার আসামি হাবিবুর রহমান ওরফে মোটা হাবিব ও মোশাররফ নামে দুই মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত তিনটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ গোলাবারুদ ও মাদক বিক্রির টাকা উদ্ধার হয়েছে। র‌্যাবের অভিযান টের পেয়ে মাদক বিক্রেতারা পালিয়ে গেলেও কয়েক ঘণ্টা পর ফিরে এসে পুনরায় ব্যবসা চালু করে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার  বলেছিলেন, মাদক, জাল–জালিয়াতি, চোরা চক্র, সন্ত্রাস ও অস্ত্রণ্ডচট্টগ্রামে এ পাঁচটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরা নানা তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। কোন অপরাধ কীভাবে এবং কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে এসব যাবতীয় খোঁজ–খবর নিয়েছি। বিগত কয়েক মাসে মাদকবিরোধী অভিযানে বেশ সাফল্য অর্জন করেছি। এক্ষেত্রে থানা পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী, র‌্যাবসহ সকল আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা এবং সামাজিক আন্দোলন দরকার।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের অসংখ্য মাদকের আখড়া গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামের সকল মাদকের আখড়া গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে নেওয়া হবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের কয়েকজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে।

একই প্রসঙ্গে গতকাল সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মো. আবদুর রউফ  বলেন, কমিশনার স্যার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। তার নির্দেশে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভিযানে মাদকের চালান আটক হচ্ছে। ধরা পড়ছে বিক্রেতা। মাঝেমধ্যে মূল হোতারাও বাদ যাচ্ছে না। তিনি বলেন, নগরীর চিহ্নিত মাদক স্পটগুলোর তালিকা তৈরি করে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। পাশাপাশি যারা মাদক ব্যবসা ছেড়ে সৎ পথে উপার্জন করতে ইচ্ছুক, তাদের আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করছে পুলিশ।

জানা যায়, বরিশাল কলোনির আস্তানা চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া। এলাকাটি মূলত রেলওয়ের নিজস্ব জমি। এ কলোনিতে রেলওয়ের কিছু সংখ্যক কর্মচারী বসবাস করেন। তারা তাদের বাসার আশপাশে অনেকগুলো খুপড়ি ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। এখানেই মাদকের আড্ডাখানা। বিস্তীর্ণ এ এলাকা অত্যন্ত নোংরা, ঘনবসতিপূর্ণ এবং ঝোপঝাড়ে পূর্ণ হওয়ায় এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তেমন একটা আনাগোনা দেখা যায় না। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এসব ঝোপের মাঝে মাটির নিচে লুকানো থাকে আন্ডারগ্রাউন্ড পকেট বক্স। এসব বক্সে লুকিয়ে রাখা হয় মদ, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ নানা মাদকদ্রব্য।

সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মো. আবদুর রউফের নেতৃত্বে গত বছর পরিচালিত এক অভিযানে কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিপরীতে অবস্থিত বস্তি এলাকা থেকে শুরু হয়ে রেলস্টেশনের পেছনের অংশ ও মাদারবাড়ি রেলক্রসিং ও বাসস্ট্যান্ডের পেছনে বিভিন্ন ঝোপে এ ধরনের প্রায় ৫০টি আন্ডারগ্রাউন্ড পকেট বক্স ও ১৫টি মাদক সেবনের ঘর পাওয়া গিয়েছিল।

সরেজমিনে গতকাল রাতে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের বিপরীতে বরিশাল কলোনি। মাঝখানে রেলের একটি সীমানা প্রাচীর। নির্বিঘ্নে মাদক ও টাকা লেনদেনের জন্য দেয়ালের মাঝখানে ছোট ২টি ফুটো করেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, হরহামেশা বরিশাল কলোনিতে মাদক বিক্রির হাট বসে। একই স্থান থেকে গত বছরের ২০ অক্টোবর প্রায় দেড় কোটি টাকার ১৫ লাখ ইয়াবা জব্দ করেছিল র‌্যাব। এ সময় ১৮ মামলার আসামি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক মো. ফারুক হোসেন প্রকাশ বাইট্টা ফারুক র‌্যাবের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে নিহত হয়।

নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া। স্টেশনের পার্শ্ববর্তী বরিশাল কলোনি, স্টেশন কলোনি, দারোগাহাট, মাদারবাড়ি ও কদমতলী এলাকায় মাদক এখন অবাধ। এসব এলাকায় কেবল মাদক বেচাকেনা নয়, মাদক সেবনের জন্য রয়েছে বিশেষ আস্তানা। যেখানে রাত–দিন ইয়াবা সেবনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় রয়েছে মাদকের ছোট–বড় হাট–বাজার। এমন মাদকের স্পটের সংখ্যা সহস্রাধিক। শুধু রেলযোগে প্রতিদিন নগরীতে প্রবেশ করছে কোটি টাকার মাদক। এই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত কতিপয় রেলওয়ে পুলিশ, আনসার সদস্য এবং বিভিন্ন পেশার সমন্বয়ে গঠিত দালাল চক্র।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামে রেলযোগে মাদক আসার পর মধ্যরাত থেকে শুরু হয় বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহের কাজ। মাদক বিক্রির কাজে ব্যবহার করা হয় বয়স্ক পুরুষ, নারী ও শিশুদের। যুবকদের রাখা হয় সোর্স, ইনফরমার ও বিভিন্ন দাঙ্গা–হাঙ্গামা, টাকা–পয়সা বণ্টন ও হিসাব–নিকাশের কাজে। ফৌজদারহাট অতিক্রম করার পর রেল থেকে মাদক খালাস শুরু হয়। নির্ধারিত স্টেশন ছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে রেল থামানো হয় মাদক নামানোর জন্য। সবচেয়ে বেশি মাদক খালাস হয় কদমতলী ও পুরনো রেলস্টেশন সংলগ্ন সিগন্যাল অফিস, কভার স্টোর ও বরিশাল কলোনির গেট এলাকায়।

মাদক বেচাকেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে শতাধিক কর্মী। তারা ডে ও নাইট দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করে। কাজের ঝুঁকির ওপর নির্ভর করে কার বেতন কত। এসব কর্মী বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে তুলে নিরাপত্তা বলয়। কোনো অভিযানের আলামত পরিলক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। সবাই সাবধান হয়ে যায়। নিরাপদ জায়গায় মাদক সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র–শস্ত্র নিয়ে তারা প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় মাদক বিক্রেতাদের ধাওয়া ও হামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাধ্য হয়ে পালাতে হয়।

সম্প্রতি র‌্যাবের পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ৪৩৬টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, ৫৩টি ম্যাগাজিন এবং ৫ হাজার ৭১১ রাউন্ড বিভিন্ন ধরনের গুলি ও কার্তুজ উদ্ধার করেছে। ৮৩ লাখ ৪৪ হাজার ২২৫ ইয়াবা, ৪৬ হাজার ৩০৩ বোতল ফেনসিডিল, ৩ হাজার ৪৫৫ বোতল বিদেশি মদ ও বিয়ার, ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪৯১ লিটার চোলাই মদ, ৯৩৩ কেজি ৫৭৫ গ্রাম গাঁজা, ৩৬০ গ্রাম হেরোইন এবং ৭ কেজি ৪২৫ গ্রাম আফিম জব্দ করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ছয়–সাত হাত ঘুরে মাদক যায় খুচরা বিক্রেতা ও মাদকসেবীর কাছে। এ কারণে মূল হোতারা ধরা পড়ে না।

চট্টগ্রাম কারাগারে মাদক আইনে বন্দী ও পরে জামিনে মুক্ত অন্তত ৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় অপরাধী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা না পেলে যেকোনো এলাকায় মাদক ব্যবসা করা কঠিন।

সূত্রে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীরা চার স্তরে থাকে। এর মধ্যে সাধারণত ৪ নম্বর স্তরের লোকজনই বেশি ধরা পড়ে। মাঝেমধ্যে দ্বিতীয় স্তরের কেউ কেউ ধরা পড়লেও ১ম ও ২য় স্তরের মাদক ব্যবসায়ীরা কখনো ধরা পড়ে না। এদের চিহ্নিত করাও বেশ কঠিন বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। এসব কারণে মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে থেকে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছে।

তবে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে নগর ও জেলা পুলিশ। সিএমপির কর্মকর্তারা জানান, যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তারা ফিরে এলে সিএমপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া তারা রুজি–রোজগারের ব্যবস্থা করতে রিকশা বা সেলাই মেশিন দিয়ে সিএমপি সহযোগিতা করবে। বিভিন্ন ছোট ছোট ব্যবসার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করানো হবে। সিএমপির এমন পরিকল্পনায় নগরীর কয়েকটি থানাও তাদেরকে চাকরির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে।

এদিকে অভিযান সত্ত্বেও মাদকের বিস্তার রোধ না হওয়ার কারণ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক তপন কান্তি শর্মা গতকাল আজাদীকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাদকদ্রব্য পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে চট্টগ্রাম। যে চালানগুলো আসছে, তার সবকটি যে চট্টগ্রামেই থাকছে, তা নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ভৌগোলিক কারণে চট্টগ্রামে মাদক ঢুকছে অবাধে। নদী, পাহাড় কিংবা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো অরক্ষিত। এটা মাদক পাচারের বড় একটি কারণ। দ্বিতীয়ত, আমাদের মধ্যে কতিপয় অসাধু সদস্য তাদের গোপনে সহযোগিতা করে থাকে। তৃতীয়ত, আমাদের নেটওয়ার্কিং দুর্বল। চতুর্থত, মাদকের পাচারে জড়িত রাঘব বোয়ালরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। মোবাইল কালচার আরেকটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর দুটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)  জানান, পুলিশের কতিপয় সদস্য মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে বড় কোনো অভিযান চালানোর খবর আগে–ভাগে ফাঁস করে দেয়। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য স্থায়ী চুক্তির কারণে চোখে দেখেও না দেখার ভান করে অবাধে মাদক বেচাকেনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার ওপর নির্ভর করে মাদক বেচাকেনার ধরন। সব ধরনের কম–বেশি বাধা সৃষ্টি করা গেলেও মোবাইল ফোনে মাদক বেচাকেনায় তুলনামূলকভাবে ঝুঁকি কম মনে করে মাদক ব্যবসায়ীরা।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031